top of page

কলোনিয়াল হ্যাংওভার এবং ডিকলোনাইজেশন

Hasan Mahmud

ইংরেজি ভাষার সাথে আমার সম্পর্ক আমার ছাত্রজীবনের একেবারে শুরু থেকেই। জিজ্ঞাসা করামাত্র এবিসিডি মুখস্থ বলে দিতে পারতাম দেখে স্কুলশিক্ষক আমার মা ধরে নিয়েছিলেন যে, তার জেষ্ঠ্যপুত্রের মতোই আমিও স্কুলের আরেকটা সুপারস্টার ছাত্র হতে যাচ্ছি।কিন্তু ক্লাস টু এর বার্ষিক পরীক্ষায় লিখতে না-জানায় ইংরেজীতে শূন্য পেয়ে ফেল করে বসলাম। তারপরেও ক্লাসে ১ম হয়েছিলাম। কারণ, আর কেউ যে ইংরেজিতে পাশ করেনি! ইংরেজি নিয়ে এরপর থেকেই অতিরিক্ত প্রস্তুতি নিতাম, সব পর্যায়ের পরীক্ষাতেই। ইংরেজি ভালো পারলে ক্লাসের শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পরিচিতদের মধ্যেও দেখেছি এক্সট্রা-খাতির পাওয়া যায়। এতে আমার উৎসাহ আরও বাড়ত, ইংরেজির প্রতি মোহও গাঢ় হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে, পরীক্ষায় সর্বত্র একটা আলাদা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিচরণ করেছি ইংরেজিতে খানিকটা বেশি সাবলিলতার জন্য। সমাজবিজ্ঞানের সবগুলো 'গুরুত্বপূর্ণ' বই দেখেছি ইংরেজিতে লেখা। অনেক আগ্রহ আর মুগ্ধতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি মার্ক্স, ডুর্খেইম, ওয়েবারের ইংরেজিতে অনূদিত বই। ঢাবি'র কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর জার্নাল সেকশনে গিয়ে ইংরেজিতে লেখা বিদেশী জার্নাল নাড়াচাড়া করতে পেরে মুগ্ধ হয়েছি। কোটেশন টুকে নিয়ে পাতার পর পাতা ভরেছি। পরীক্ষার খাতায় সেগুলো দাঁড়ি, কমাসহ লিখে দিয়ে এসেছি। ক্লাসে সর্বোচ্চ বা তার কাছাকাছি নম্বর পেয়ে মেলা জ্ঞানার্জন হয়েছে মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি। তবে ক্লাসের বাইরের এইসব পড়ার মধ্যে আধাআধি বা তারচেয়েও কম যেটুকু বুঝতাম, তাতে টের পেয়েছিলাম যে, সমাজবিজ্ঞান পড়তে হলে ইংরেজিটা আরও ভালো করে জানতে হবে এবং সাদাদের দেশেই যেতে হবে উচ্চশিক্ষার জন্য।


দেশের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েই অনুভব করেছিলাম যে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় নেই। যা কিছু ছিল, তাকে কলেজের উচ্চতর ভার্সনই বলা যায়। কারণ, কলেজে যেমন টেক্সট বই থেকে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে পাশ করা হতো, বিশ্ববিদ্যালয়েও একই রকম পেয়েছি। কোন ক্রিটিকেল পড়া নাই, টেক্সটকে প্রশ্ন করা নাই, সাদাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে নিজেদের সমাজের প্রেক্ষিতে বোঝাবুঝির চর্চা নাই। কোন নতুন গবেষণা ত নাইই, স্বীকৃত কোন গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করাও নাই। বলছি আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বাইরে গিয়ে ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করলাম প্রশ্ন করা, একটু একটু করে অর্জন করলাম প্রশ্ন করার সাহস। ক্লাসরুমে অধ্যাপক হাতেকলমে শিক্ষা দিতেন কিভাবে ক্রিটিকেল চিন্তা করতে হয়, প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। প্রায়শঃই সদ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষককে ক্লাসে নিয়ে এসে আমাদের জন্য প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিতেন অধিকাংশ শিক্ষক। এমনকি নিজের গবেষণা থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধ ও বইকে ক্রিটিকেলি প্রশ্ন করতে এবং সীমাবদ্ধতাগুলো উল্লেখ্য এবং আলোচনা করতে বলতেন। এইভাবে বুঝতে শুরু করলাম যে, জ্ঞান কিভাবে অর্জন করতে হয়। এখনো সেই ট্রেনিংএর মধ্যেই আছি। হয়তো জীবনের কোন এক পর্যায়ে জ্ঞানের আশেপাশে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে - এই ভরসায় এখনো পড়ি, সমালোচনা করি, আবার পড়ি, আবার সমালোচনা করি। তবে এই সমালোচনার উদ্দেশ্য নিজের বোঝাবুঝিকে নিয়ে, যাতে নিজের চিন্তাভাবনাকে আরও বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিসংগত করা যায়। আর যে বই বা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তা' ত আর বদলানোর কিছু নেই। কাজেই, সেটা নিয়ে আগ্রহও ঐ ক্রিটিকেলি পড়া পর্যন্তই।


যাই হোক, আসল কথায় ফিরে যাই। কলোনিয়াল হ্যাংওভার আমার মাঝে ছিল। কিন্তু ক্রমশঃ উপলব্ধি করেছি যে, উন্নত জ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যেকোন কিছুকেই বিনা-প্রশ্নে গ্রহণ করার কোন বাস্তবিক যুক্তি নাই, প্রয়োজনই নাই। ইউরোপ সভ্য আর বাদবাকি সবাই অসভ্য এবং তাদের অমোঘ নিয়তি ইউরোপকে অনুসরণ করার মধ্যে নিহিত - এইটা একটা ছেলেমানুষি বিশ্বাস। আমাদেরকে ইতিহাসের ভুল পাঠ দিয়ে, শিশুতোষ কাহিনীকে উন্নত জ্ঞানের নামে মুখস্থ করিয়ে হাওয়ার উপরে ইউরোপীয় কলোনিয়াল মাস্টারদেরকে মহিমান্বিত করা হয়েছে এবং তাদের প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞ থাকার "শিক্ষা" দেওয়া হয়েছে। যেমন, আমাদেরকে শেখানো হয়েছে যে,


(১) ইউরোপে শিল্পবিপ্লব হয়েছে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে (যেন এতে কলোনিয়ালিজমের কোন ভূমিকাই ছিলনা),

(২) বৃটিশরা আমাদেরকে কলকারখানা এবং রেলপথসহও নানান আধুনিক প্রযুক্তি দান করেছে,

(৩) গণতন্ত্র এবং এরসাথে সম্পর্কিত উন্নত প্রশাসন ব্যবস্থা দিয়েছে।


ভারতের কংগ্রেসের সাবেক মন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক আন্ডারসেক্রেটারি শশী থারুর এইধারার বক্তব্যকে তথ্য, যুক্তি এবং হিউমারের মাধ্যমে দারুণভাবে ভুল, অনৈতিহাসিক এবং অযৌক্তিক প্রমাণ করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিয়নের এক বিতর্কমঞ্চে। তার ১৫ মিনিটের সেই বক্তব্যটা দিলাম এইখানে ইউটিউব থেকে


পরিসংখ্যান এবং যুক্তি দিয়ে থারুর দেখিয়েছেন কিভাবে ভারতবর্ষে বিদ্যমান বস্ত্র-পোশাক শিল্পকে সিস্টেম্যাটীকেলি ধ্বংস করে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে, ইংরেজরা ভারতে রেলপথ কেন স্থাপন করেছে, কিভাবে ১৫০ বছর ধরে তারা ভারতীয়দের স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামকে সহিংস উপায়ে দমন করেছে, কিভাবে ৩ মিলিয়ন বাঙালিকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়ে হত্যা করেছে।


আমি ডিকলোনাইজেশনের কথা বলি। ডিকলোনাইজড চিন্তার একটা চমৎকার উদাহরণ থারুরের এই বক্তব্যটা। তাছাড়াও ইউটিউবে সার্চ করলে অনেক বক্তব্য পাওয়া যাবে ডিকলোনাইজেশন কি এবং কি কি উপায়ে জ্ঞানের জগতে এটি অর্জনের চেষ্টা করা যায় তা নিয়ে নানান আলাপ।


মুক্তামনা হতে হলে সবার আগে মনকে মুক্ত করতে হবে কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটিয়ে।


কথা শেষ। :)


 
 
 

Recent Posts

See All

Comments


Connect

  • LinkedIn
  • YouTube
  • Facebook
  • Twitter

Copyright © 2020

Hasan Mahmud.

All rights reserved

bottom of page