নোটঃ ছবিটি ২০ মে, ২০২০ সালে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকা থেকে সংগৃহ করেছি।
গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যেম শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশী মুহম্মদ ইউনুসের জন্মদিন উপলক্ষে ফেসবুকে বেশকিছু পোস্ট দেখলাম। সেসবে ব্যক্তি ইউনুসের মহত্বের কথা যতটা এসেছে, ঠিক ততোটা ক্ষুদ্রঋণের দারিদ্র্যবিনাশী ভূমিকা আসেনি। মনে হলো ক্ষুদ্রঋণের কথা লোকে ভুলতে বসেছে। তাই দশ বছর আগে লেখা এই ব্লগটা আবার শেয়ার করছি। কীর্তিমানের যে কাজ তাকে মহত্ব দিয়েছে, তাকে বাদ দিয়ে ব্যক্তির মহত্বের বোঝাপড়া ত অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
১
আমি গ্রামের ছেলে, গ্রামে জন্ম, গ্রামেই বেড়ে ওঠা। ক্ষুদ্রঋণের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আমার নিজের গ্রামেই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেই ১৯৮৭/৮৮ সাল থেকে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে - বিশেষ করে যারা সেই ঋণের গ্রহীতা - কখনো কোনরূপ উম্মাদনা দেখি নাই। এমনকি ডঃ ইউনুসের নামডাকও সেভাবে শোনা যায়নি। তিনি যে মহাপুরূষ জাতীয় কেউ একজন আর ক্ষুদ্রঋণ যে দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানোর এক মহান পদ্ধতি তা’ জানার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলের এক গ্রামের ধূলো মেখে গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণের সাথেই বেড়ে ওঠা এই আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কলেজ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা অব্দি। ১৯৯৭ এ কলা ভবনে আসার পর সমাজসেবা/দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীমুক্তি ইত্যাদিতে অবদানের জন্য নানা দেশ/সংস্থা থেকে ডঃ ইউনুসের বিভিন্ন পুরষ্কার প্রাপ্তির সংবাদ শুনতে শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বেশ গর্বিত হতাম এই ভেবে যে, গ্রামীণের ক্ষুদ্রঋণের মত একটা মহান ব্যবস্থার সাথে জন্মলগ্ন থেকে নিবিড়ভাবে পরিচয় আছে। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের সাথে আমার শৈশবকালের কাছে থেকে দেখা কিছু মানুষের সম্পর্ক এবং তাদের পরবর্তী জীবন দেখে ক্ষুদ্রঋণের এই মহত্বের আব্রু ছিঁড়েও গেছে খুব তাড়াতাড়িই।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার এই মোহভঙ্গের প্রথম দিনটির কথা। সবসময় ঢাকা থেকে ট্রেনে করে বাড়ি যেতাম। ১৯৯৮ এর প্রথম দিকে। রিক্সায় করে কমলাপুর যাচ্ছি। মতিঝিল টিএন্ডটি কলোনীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক রাস্তার কোণে পানের দোকান থেকে দোকানী উচ্চস্বরে আমার ডাকনাম ধরে ডেকে উঠলো। উল্লেখ্য, মামাবাড়ি ছাড়া ঢাকা শহরে আমাকে ঐ নামে ডাকার মানুষ থাকার কথা না। আমি চমকে পেছন ফিরে দেখি আমাদের পাড়ার এক প্রতিবেশী ডাকছে। রিক্সা ঘুরিয়ে তার কাছে গেলাম। আমাকে আপ্যায়ণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। অনেক মানা করার সত্বেও পাশের দোকান থেকে কলা আর চা কিনে খাওয়ালো। এরই মধ্যে আমি তার বর্তমান অবস্থা জানলাম। তাদের পানের বরজ (পানক্ষেত) বিক্রি করে সে বাবার সাথে পানের পাইকারী ব্যবসা ধরেছিল। সেটাতে টিকতে না পেরে মা’কে নিয়ে ঢাকায় এসেছে। নিজে ছোট্ট পানের দোকান নিয়ে বসে, আর মা’ বাসাবাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করে। বাবা অসুস্থ, তাই গ্রামের বাড়িতে থাকে। সে বলল, এনজিও’র লোকজন এসে তার মা’কে বলেছিল ক্ষুদ্রঋণ নিলে তাদের পানের বরজ আরো বড় করতে পারবে, তা’তে অনেক লাভ হবে। কিন্তু পরের বছর অতিবৃষ্টি আর বন্যায় বরজ নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার মা’ আরো ঋণ নিয়ে তার বাবাকে পানের পাইকারী ব্যবসায় নামায়। সেখানে লাভ ভালো হলেও বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ে। ফলে আর কোন উপায় না দেখে তারা পানের বরজ বন্ধক দিয়ে ঋণ শোধ করে দেয়। আর মা’কে নিয়ে ঢাকা শহরে চলে আসে। উল্লেখ্য, সে তাদের এই অবস্থার জন্য ক্ষুদ্রঋণকে কোন দোষ দেয়নি। বন্যায় পানের বরজ নষ্ট হওয়া, বাবার অসুস্থতার জন্য ব্যবসায় ক্ষতি হওয়া, এসবকে সে বলেছিল তাদের ‘কপালের ফের’।
সেইবার বাড়ি গিয়ে শুনি যে মহিলার কাছ থেকে আমরা ভাপাপিঠা কিনে খেতাম ছোটবেলা থেকে, সে নাকি ঢাকায় চলে যাচ্ছে। সেই মহিলা প্রতিদিন বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসত। আম্মাকে খালা ডাকত এবং তার কাছে টাকা জমা রাখত। নিজেদের ভিটামাটী ছাড়া আর কিছুই ছিলো না বলে তার স্বামী দিনমজুরী করতো। আর সে গ্রামীণের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে প্রতি সপ্তাহে ৪/৫ মণ ধান কিনে সেটা সিদ্ধ করে, ঢেকিতে চাল ভেনে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতো। শীতের সময় এই কাজের পাশাপাশি সকালে ভাপা পিঠা বানিয়ে পাড়ায় বিক্রি করতো। [আমার এখনো মনে পড়ে শীতের ভোরে কুয়াশা মাড়িয়ে ধানক্ষেতে আইল ধরে পায়ে হেটে তার বাড়ির ঊঠানে বসে আগুনের তাপ পোহানো, কলাপাতায় মুড়ে সাদাসাদা ভাপ-ওঠা গরম ভাপা পিঠা নিয়ে বাড়ি আসা, প্রায়শঃই দেরি করে ফেরায় আম্মার ঝাড়ি খাওয়া।] আমি প্রথমে অবাক হয়েছিলাম তার ঢাকায় চলে যাওয়ার কথায়। কারণ, আমি জানতাম তার অবস্থা দিনে দিনে বেশ ভালো হচ্ছিল। সে আমাদের বাড়ির পাশে বিঘাখানেক জমি বন্ধকও নিয়েছিল। বড়ছেলেটা কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। তাকে ঢাকায় যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল চাল বেচে আর আগের মতো লাভ হচ্ছে না। কারণ, গ্রামে দুইটা চালকল (রাইসমিল) বসেছে। তাই বাজারে তার চালের দাম কমে গেছে। তাছাড়া তার স্বামী প্রায়শঃই জোর করে তার ব্যবসার টাকা নিয়ে নেয়। তাই সে ঠিক করেছে জমি থেকে বন্ধকী টাকা তুলে নিয়ে সব ঋণ শোধ করে দিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। – সেও তার ভাগ্যকে দোষারোপ করলো গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যেতে বাধ্য হওয়ার জন্য। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সে ত’ ভালো করছিল? তাহলে তাকে সব ছেড়ে ছুড়ে গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে কেনো?- মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি ঢুকে পড়ল।
সেইবারের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে জানলাম গ্রামের পরিচিত স্বল্প-আয়ের অনেক পরিবার ঢাকা শহরে চলে গেছে/যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। ব্যাপারটা কিভাবে যেন মাথায় মধ্যে রয়ে গেলো। সমাজবিজ্ঞানে পড়ি, প্রতিদিন কলাভবনে-টিএসসিতে-লাইব্রেরীর সামনে-বুয়েটে নানান জায়গায় বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় সময় কেটে যায়। দিন কেটে যায়, আড্ডার পরিধি বাড়ে, জানাশোনারও। প্রায়শঃই বিকেলগুলো-সন্ধ্যাগুলো কেটে যেতে থাকে মধূর কেন্টিনে। প্রয়োজনীয়/অপ্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে আড্ডার মাঝে উঠে আসে ক্ষুদ্রঋণ আর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডঃ ইউনুসের পুরষ্কার প্রাপ্তির খবর। মাঝেমধ্যে আবার ক্ষুদ্রঋণের শোষণের কথাও শুনি। আর দেখতে থাকি ঢাকা শহরটা ক্রমেই ভরে উঠছে গ্রাম থেকে আসা ক্ষুদ্র আয়ের মানুষগুলোয়। তারা আসছে দেশের সব অঞ্চল থেকে। আস্তে আস্তে ঢাকা শহরের বস্তিগুলো ঘরছড়া গ্রামীন মানুষে ভরে উঠছে। রাস্তাগুলো রিক্সায় ভরে উঠছে। ফুটপাতে জমে উঠছে অল্পমূল্যের খাবারের বিকিকিনি।
শেষেরদিকে পাড়া-প্রতিবেশী কাউকে ঢাকায় রিক্সাচালাতে দেখলে আর অবাক হতাম না। কারণ, প্রায়শঃই কাউকে না কাউকে দেখা যেত। সবার কাছেই শুনতাম তাদের দূর্ভাগ্য আর ঢাকায় আসার কালপঞ্জী। মনের মধ্যে থাকা অস্বস্তিটা ক্রমশঃ বাড়তে লাগল একদিন এক আড্ডার পর থেকে। সেখানে একজন হিসেব কষে দেখালো যে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তিন/পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ঋণ নেওয়ার পরের সপ্তাহ থেকেই বায়ান্নো (অন্য বন্দোবস্তও আছে) কিস্তিতে টাকা শোধ করায় সুদের প্রকৃত হার শতকরা চল্লিশ ছাড়িয়ে যায়। উপরি হিসেবে নিজেদের কাজ ফেলে মিটিংয়ে অংশ নেওয়া, প্রতি সপ্তাহে সদস্য ফী জমা, সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তি আদায়ে সাহায্য করা, ইত্যাদি ত আছেই। সেখান থেকে আমি ফিরে দেখতে শুরু করলাম সেইসব প্রতিবেশীর কথা যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছিল, এখন গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছে। সুদের হার নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম কেন ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক আমার সেইসব প্রতিবেশীরা সবাই ব্যবসায় ব্যর্থ হয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, নিজের ঘর ছেড়ে বস্তিতে বাসা বেঁধেছে।
গ্রাম-বাংলায় এমন কোন ব্যবসা আছে কি যেখানে মাত্র ৫/৬ হাজার টাকা খাটিয়ে ৪০% মুনাফা করা যায়, তা-ও আবার প্রথম সপ্তাহ থেকেই? (সারা পৃথিবীতেই আছে কি?) সব ব্যবসায়ই রিস্ক আছে - পানের ব্যবসা, চালের ব্যবসা, কাঁচা তরিতরকারির ব্যবসা, গরুছাগল পালন - গ্রামীণ অর্থনীতির এইসব ব্যবসায় সেই রিস্ক আরো বেশি। বন্যা আছে, খরা আছে, বাজারে বহুজাতিক কোম্পানীর এজেন্ট আছে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সেইসব দরিদ্র নারীদের জন্য আরো আছে মাতাল-জুয়ারী স্বামী, আছে নারীর সতীত্ব নিয়ে সদাচিন্তিত সমাজ। এইসব রিস্কের মোকাবিলায় নারী উদ্যোক্তা কিন্তু একেবারেই একা। এইসব রিস্ক একা নিজের কাঁধে নিয়ে দরিদ্র নারী উদ্যোক্তা কত দূর যেতে পারে? - এইটুকু বোঝার জন্য মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, ব্লগের লেখক/পাঠক এই আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্লাসে, সভা-সেমিনারে যেতে হলেও গ্রামের আধা-শিক্ষিত লোকজনকে কোথাও যেতে হয়না। তারা তাদের আশেপাশে ক্ষুদ্রঋণের কাজকারবার থেকেই শিখে নেয় যে এটা একটা মরণ ফাঁদ। একবার এক ফাঁদে পড়লে ভিটেছাড়া হওয়ার আগে আর মুক্তি মেলে না।
ক্ষুদ্রঋণওয়ালাদের একমাত্র চিন্তা তাদের নির্ধারিত হারে কড়ায়গন্ডায় সুদে-আসলে ঋণ আদায় করা। ব্যবসায়ের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী লগ্নিকারী ব্যাংক ব্যবসায়ীদের এইসব রিস্ক কমাতে কিস্তি নেওয়া শুরু করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে, ব্যবসায় ক্ষতি হলে সুদ কমায় বা মাফ করে, ব্যবসা-সংক্রান্ত নানান তথ্য দিয়ে উদ্যোক্তাদের সহায়তা করে, এমনকি ব্যবসায় ধরা খেলে ঋণ-খেলাফি হওয়ার এবং দিব্যি আগের মতোই ঠাটেবাটে চলার ফাঁকফোকড় থাকে (আমাদের জাতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কারে রেখে কার নাম বলব, সবাই ত এই দলে)। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের জন্য এইসব কোন সুযোগই নেই। এমনকি তাদের জন্য দেউলিয়া হওয়ারও কোন উপায় নেই। ঘরের চাল, গোয়ালের গরু, মাঠের ফসল, যা’ কিছু দিয়ে হোক, ঋণের টাকা সুদেমূলে শোধ দিতেই হবে। তা’ সে গ্রহীতার সম্মতিক্রমেই হোক আর জোর-জবরদস্তি করেই হোক। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই, শুধু ‘মুক্তমন’ নিয়ে কিছু একাডেমিক পেপার পড়লেই জানা যাবে ক্ষুদ্রঋণ কি, এটা কিভাবে দরিদ্র নারীদেরকে অর্থনৈতিক মুক্তির মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ঋণের জালে বন্দী করে, আর কিভাবে সংসার নিংড়ে সেই নারীসহ তার পুরো পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। আর যারা পড়ার কষ্টটুকু করতে চাননা তাদেরকে বলি, প্রতি বছরই ত আপনারা কত জায়গায় বেড়াতে যান, একবার না হয় কক্সবাজার-বান্দরবন-ব্যাংকক-মালয়েশিয়া বাদ দিয়ে আপনার ঘরের কাছেই কোন একটা গ্রামে যান। একটা দিন কাটিয়ে আসুন মাটির কাছাকাছি থাকা কিছু মানুষের সাথে। বাড়ির পাশেই সারা বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ক্ষুদ্রঋণের মডেল চলছে, সেটা দেখার কৌতুহল মিটবে, পাশাপাশি টাকার সাশ্রয়ও হবে।
২
২০০০ সালের দিকে গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ আর্থিক দূর্গতির জন্য তাদের কপালকে দায়ী করত। ২০১০ সালের দিকে এসে তারাই তারা ক্ষুদ্রঋণকে দায়ী করা শিখেছে। তারা বুঝতে শিখেছে যে, ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতাদের সবারই একই সাথে একই ভাবে দূর্ভাগা হওয়ার কোন ঐশ্বরিক কারণ নেই। আর ব্যক্তিগত ভাবে তারা কেউই দায়ী না তাদের আর্থিক অসংগতির জন্য। যে-ই ক্ষুদ্রঋণ নেয়, সে-ই ক্ষতির মধ্যে পড়ে। কাজেই, ক্ষুদ্রঋণই এর জন্য দায়ী। ক্ষুদ্রঋণের কাঠামোর মধ্যেই নিহীত গ্রহীতাদের যাবতীয় দূর্গতি। কাজেই, এই ক্ষুদ্রঋণের কান্ডারী মহামতি ডঃ ইউনুসই হোক, কুখ্যাত জয়নাল হাজারীই হোক, কিংবা মাস্তান কালা জাহাঙ্গীরই হোক, ফলাফল একই হবে- ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হবে।
কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ যদি এতোটাই ভয়ঙ্কর হবে তাহলে তা’ সাধারণভাবে আমাদের মিডিয়ায় আসছে না কেন? আমাদের স্কুলে-কলেজেই বা এই বিষয়ে জানানো-পড়ানো হয় না কেন?- এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্র নিজেই এই ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। মনে রাখতে হবে, জন্মলগ্ন (১৯৮৪) থেকেই গ্রামীন ক্ষুদ্রঋণ সরকারের কাছ থেকে কর-মওকুফসহ নানান সুবিধা পেয়ে আসছে (অথচ নিজের দরিদ্র সদস্যেরকে গ্রামীণ একদিনও ছাড় দেয় না)। পাঠ্যপুস্তকে ক্ষুদ্রঋণের বিষয়ে ভালো ভালো কথা (যা’র সবটাই গালগল্প) ছাড়া কোন সমালোচনা করা নাযায়েজ (কেনো তা’ জানতে এই লিঙ্কে যান)। আর মিডিয়া কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নরওয়ের এক সাংবাদিক গ্রামীণ ক্ষুদ্রঋণের উপর একটা প্রামান্যচিত্র প্রকাশ করে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল। সেই প্রামান্যচিত্রের বড় অংশই ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতাদের দূর্দশা তুলে ধরেছে। পাশাপাশি আর্থিক দুই নম্বরীর মাধ্যমে গ্রামীণের পেট থেকে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার অবৈধ জন্মের কাহিনী ফাঁস করেছে। অথচ, মিডিয়া মূল ঘটনা তথা ক্ষুদ্রঋণের নেতিবাচকবা প্রভাবের বিষয় আড়াল করে এর আর্থিক দূর্নীতি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিল। ভাবটা এমন যেন, গ্রামীণের ঐসব আর্থিক লেনাদেনাকে বৈধ্য প্রমাণ করতে পারলেই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের দূর্ভোগগুলো সৃস্টি করাও বৈধ হয়ে যাবে!
৩
ফেসবুকে দেখলাম মুহম্মদ ইউনুসের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানানর সাথে সাথে ক্ষুদ্রঋণ এবং সেইসাথে এর প্রবক্তার সমালোচনাকে অকৃতজ্ঞতা এবং মানহানিকর বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণের বা মুহম্মদ ইউনুসের সমালোচনা করাটা অন্যায্য এবং ক্ষুদ্রমনের পরিচায়ক। একইভাবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ক্রিটিকেল আলাপের পথ বন্ধ করে রাখতে আমাদের মিডিয়াও দেশপ্রেম এর বয়ান শোনায়। ডঃ ইউনুস ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে নোবেল শান্তি পুরষ্কার এনে আমাদের জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কাজেই, তাকে এবং তার প্রবর্তীত ক্ষুদ্রঋণের সমালোচনা করা মানে হলো জাতীয় গৌরবের মুখে কালী লেপন করা। অতএব, যারাই এর সমালোচনা করবে, তারাই জাতীয় শত্রু, দেশের শত্রু। আর দেশপ্রেমিক তারাই যারা সুনাম গাইবে। কিন্তু আমি শৈশবের প্রাণবন্ত সেইসব মানুষের কথা ভুলি কি করে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে মলিন মুখে ঢাকার রাস্তায় রিক্সা চালায়, কি বাসাবাড়িতে ঘর মুছে? যাদের হাসিখুশী মুখ মিশে আছে আমার সমগ্র শৈশব-কৈশর জুড়ে? তাদের বাদ দিয়ে আমি দেশ ভাবতে পারিনা। তাদের ভালো-মন্দ মিশে আছে আমার স্বদেশ ভাবনায়। আর তাই আমার দেশপ্রেম ক্ষুদ্রঋণের বেপারী আর তার ভক্তকূলের দেশপ্রেম থেকে আলাদা। একারণেই, প্রথম দিকে ঢাকা শহরে এবং পরবর্তিতে দেশের বাইরে দেশীভাইদের সাথে ক্ষুদ্রঋণের গুণগানের মজলিশে শামিল হয়ে নিজের দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছি।
আমার কাছে ক্ষুদ্রঋণের প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচন করার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের (এবং অন্যান্য ক্ষুদ্রঋনের ব্যবসায়ী এনজিওগুলোর) রক্তচোষা চরিত্র দেখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এর ভয়ানক থাবা থেকে দরিদ্রদেরকে উদ্ধার করা মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যদি পাকিস্থানের শোষন থেকে জনগণের মুক্তির প্রচেষ্টাকে আমাদের দেশপ্রেমের দাবী মানি, তাহলে ক্ষুদ্রঋণের শোষণ থেকে কয়েক কোটি মানুষকে উদ্ধার করাও দেশপ্রেমেরই দাবী। কারণ, মানুষ না বাঁচলে দেশ বাঁচেনা। আর ক্ষুদ্রঋণ এর গ্রহীতাদেরকে যে জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তাকে মানবেতর জীবন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই কারণে, সকল দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীকে আমি দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য নিয়ে ব্যবসার হীনস্বার্থের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে অনুরোধ করি।
Comments