
নোটঃ ছবিটি সামহোয়ারইন ব্লগ থেকে সংগৃহীত।
১
আজকের আলাপটা একেবারেই ঘটনাক্রমে মাথায় আসল। কয়েকদিন আগে আমার ১ম মাস্টার্স থিসিস গবেষণার ভিত্তিতে লেখা প্রথম আর্টিকেল নিয়ে কথা বলার ফাঁকে বলেছিলাম যে, আমার গবেষণাটা ছিল গাঁঞ্জাখোর পরিচয়ের উপর। একজন বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এমন বিষয়েও সমাজবিজ্ঞানে গবেষণা হয়? এর আগেও দেখেছি বেশিরভাগ মানুষকেই অবাক হতে। তারা ধরেই নিত যে, আমার গবেষণাটি ছিল গাঞ্জাখোরদেরকে নিয়ে। এমনকি আমার থিসিস ডিফেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকও এমনটিই মনে করে আমার গবেষণাকে অনৈতিক এবং সেইজন্য অগ্রহনযোগ্য বলে রায় দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এরা সকলেই একটা ছোট্ট ভুল করেছিলেন। ব্যাপারটা খোলাসা করে বলছি ভাষার মধ্য দিয়ে ভাবের লেনাদেনার আলাপে।
Ferdinand de Saussure তার Course in General Linguistics (1915) বইয়ে langue (ভাষা) এবং parole (বাক্য) এর মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছেন, যা পরবর্তীকালে ভাষাতত্ত্ব নামক একটা স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিনের জন্ম দিয়েছে। তার মতে, ভাষা হল সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম কানুনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটা নৈর্ব্যক্তিক কাঠামো যা’র মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব হয়। আর এইসব নিয়ম কানুনের চক্করের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাব যে আকারে প্রকাশিত হয়, তা’ই হল বাক্য বা কথা। (উচ্চারিত বাক্য বা কথাই কিন্তু ভাবের একমাত্র প্রকাশিত রুপ নয়। ভাব নিজেকে অনুচ্চারিত রেখেও প্রকাশিত হতে পারে, যেমন, চোখমারা, চিমটিকাটা, ইত্যাদি)। তাহলে, ভাষা হলো এটা সাধারণ বিষয়, আর বাক্য বা কথা হলো ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষ ভাব।
ভাবের এই যে সাধারণ আর বিশেষ অস্তিত্ব, তা আমরা আলাদা করে বুঝবো কি করে? আর বুঝেই বা কি লাভ হবে?- আমার মতে, জ্ঞানচর্চার একেবারে শুরুর দিকের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে সাধারণ আর বিশেষ এর মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন। এই বিষয়ে দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাবার মতো একটা ভাসা ভাসা একটা ধারণা আমাদের সবারই কমবেশি আছে। কিন্তু কোন কিছুর প্রকৃত অর্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই বিষয়টার পুরোপুরি আয়ত্বে আনা জরুরী। কিভাবে?

নোটঃ ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
২
ফুল আর গোলাপ এর মধ্যে সম্পর্ক কি? – আপাতদৃষ্টিতে এই প্রশ্নটা এতটাই সরল যে, কাউকে জিজ্ঞাসা করলে আমার মাথার সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ সন্দেহ করবে। কারণ, আমরা সবাই কিন্তু বুঝি এই সম্পর্কটা, তাই না? কিন্তু একটু ভালো করে ভেবে দেখুন তো ফুল আর গোলাপ এর মধ্যে সম্পর্কটা আসলেই কেমন? – প্রথমটা সাধারণ, আর দ্বিতীয়টা বিশেষ। অর্থ্যাৎ, প্রথমটা দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস যা ফুল নামে পরিচিত তাদের বৈশিষ্ট্যাবলির একটা সাধারণ ধারণা মনের মধ্যে তৈরী করছে, আর দ্বিতীয়টা সেই ধারনার আলোকে একটা বিশেষ জিনিস নির্দেশ করছে যা সেইসব বৈশিষ্ট্যাবলি ধারন করে, কিন্তু আরো কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে অন্য সমজাতীয় জিনিসগুলো হতে আলাদা (স্বতন্ত্র)।
গোলাপ নামক জিনিসটি তার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে ফুল, আর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে গোলাপ ফুল। তারমানে, গোলাপফুল জিনিসটা কি তা উপলব্ধি করতে গেলে ফুলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং গোলাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দুই’ই অনুধাবন করতে হয়, একই সাথে। ফুলের সাধারন বৈশিষ্ট্যবালী কি কি? প্রথমতঃ ফুল উদ্ভিদজাত, এটি উদ্ভিদের বংশবিস্তারের সাথে সম্পর্কিত (আরো কতগুলো থাকতে পারে, কিন্তু আলোচনার জন্য দুটোই যথেষ্ট)। এরপর যে সব বৈশিষ্ট্য আসে, তা’র প্রায় সবই বিশেষ বিশেষ ফুলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন, বিশেষভাবে নির্দিষ্ট উদ্ভিদ, রং, সুবাস, আকার, ফোটার সময়, ইত্যাদি।
সাধারণভাবে ফুল বলে কি অর্থবোধক কিছু আছে?
– না, নাই। কারণ, শুধু উদ্ভিদ-জাত বা বংশবিস্তারের সাথে সম্পর্কিত দিয়ে কোনকিছুর ভাবই প্রকাশিত হয় না। তাই যা কিছুই আমরা ফুল হিসেবে জানি, সেগুলো সবই বিশেষ ফুল - গোলাপ, বেলী, হাস্নাহেনা, ইত্যাদি যারা সবাই ফুলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং একই সাথে নিজ নিজ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাস্তবে বিদ্যমান। তারমানে, কেবলমাত্র সাধারণ বৈশিষ্ট্য কোন কিছুর ভাব প্রকাশে অসম্পূর্ণ। আর তাই অক্ষম।
তাহলে, কোন বিশেষ জিনিসের রং, আকার, সুবাস গোলাপ ফুলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সাথে মিলে গেলেই কি তাকে গোলাপফুল বলব? কাগজ, রাবার, ইত্যাদি দিয়ে কৃত্রিমভাবে একটা জিনিস ত বানানো যায়ই। কিন্তু তাকে ত গোলাপফুল বলবো না। বলবো কাগজের গোলাপ, বা রাবারের গোলাপ, বা অন্যকিছু। একারনেই যাবতীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকার পরেও শুধুমাত্র ফুলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য না থাকায় জিনিসটা গোলাপ হয়ে ওঠে না। কাজেই, শুধু বিশেষ বৈশিষ্ট্যও কোন কিছুর ভাব প্রকাশে অসম্পূর্ণ। আর তাই অক্ষম।
অতএব, আমাদের ভাবের লেনদেনের ক্ষেত্রে কোন জিনিস তখনই পরিপূর্ণ অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন তা একই সাথে সাধারণ এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যাবলি ধারন করে। একারনেই কোন জিনিস/বস্তু/বিষয়ের সাধারণ ধারণাগুলো থাকার পরও আমরা বিশেষ কিছু খুঁজি সেই বিষয়টার অর্থ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার জন্য। কিন্তু এই সাধারণ এবং বিশেষ সর্বদাই একত্রে উপস্থিত থেকে অর্থময় ভাব উৎপন্ন করে। অনুভবের স্তরে (বিমূর্ত) এদের আলাদা করা যায় ঠিকই, কিন্তু (বাস্তবে) এই পার্থক্য চাক্ষুস করা যায় না। মানুষ কে দিয়ে আরেকটা উদাহরণ দেই। –
মানুষ কি? – আমরা সবাই জানি এর উত্তর। আসলেই কি জানি? মানুষ কি তা জানলে ত উদাহরণ দিতে পারার কথা। একটা উদাহরণ খুঁজুন ত। – এটা একটা ব্যাপার? আমি নিজে, আমার বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই ত মানুষ। কি পেলেন?
– না, সাধারন মানুষ পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে বিশেষ একেক জন মানুষ। কারন, এরা সবাই মানুষের সাধারন বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়েও কিছু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একেকজন বিশেষ একজন মানুষ, তাই না? – তাহলে সাধারণ অর্থে মানুষ কি তা অনুধাবন করতে পারলেও বাস্তবে যে মানুষকে পাওয়া গেল, তা বিশেষ মানুষ। এখানে গোলাপফুলের মতো একই ভাবে মানুষের সাধারন এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমন্বিতভাবে পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করছে।
সাধারণ আর বিশেষ এর মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটা আধার এবং আধেয় এর মতো। আধার ছাড়া আধেয় নাই, আবার আধেয় না থাকলে আধার অপূর্ণ। জগতের সাধারণ মানুষ ভাবটা তাই অনিবার্যভাবেই একটা আধার, যা নিজের মধ্যে দিয়ে আপনি-আমিসহ সকল বিশেষ মানুষকে অর্থময় করে তোলে। কাজে কাজেই সাধারণ মানুষ ভাবের একটা কাঠামো যা’র মধ্যে আমাদের সবার নিজ নিজ মানুষ-ত্ব-এর অর্থ নিহিত। একারনেই আমি কে তা বোঝার জন্য আগে মানুষ কি তা বোঝা জরুরী। আসুন, এইখানে লালনকে স্বরণ করি। –
“বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা একঘর পড়শি বসত করে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গিরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা নাই তরণি পারে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে, ক্যামনে সেথা যাইরে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
কি বলবো পড়শিরো কথা, হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে। ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর ক্ষণেক ভাসে নিড়ে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
পড়শি যদি আমায় ছুতো, যম যাতনা সকল যেতো দূরে। সে আর লালন একখানে রয়, – তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা একঘর পড়শি বসত করে। আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”
– লালনের এই মানুষ হল সাধারণ মানুষ যার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি-লালনের নিজের মানুষ-ত্ব (মনুষ্যত্ব নয় কিন্তু) অনুভব সম্ভব হয়। এই ভাব/উপলব্ধি/জ্ঞানটাকে ধরার জন্য তাই লালন ব্যাকুল। লালন এটাও বুঝতে পারছেন যে, এই সাধারণ মানুষটা তার উপলব্ধির/অনুভবের খুব কাছেই আছে (যেমন, সাধারণ মানুষ সম্পর্কে আমাদের ধারনা), কিন্তু তাকে ঐরূপে ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই। কারণ, সে সর্বত্র বিরাজমান হলেও তার কাছাকাছি যাবার উপায় নাই (পড়ুন, ভাষা নাই)। কারণ, তা’র হাত-পা-কাঁধ-মাথা নাই (অর্থ্যাৎ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নাই যার মাধ্যমে তাকে আলাদা করে চেনা যাবে)। ফলে এই সাধারণ মানুষ আমাদের অনুভবে দেখা দিয়েও বাস্তবে ধরা দেয় না। ঠিক লালনের পড়শির মতো। লালন শেষ করছেন এই আঁকুতি নিয়ে যে, সেই সাধারণ মানুষকে ধরতে পারলে, নিজের উপলব্ধিতে সম্পূর্ণরূপে আনতে পারলে তার সমস্ত দুঃখ-কষ্টের বোধ লোপ পেত।
ভাষাতত্ত্ব সাধারণ আর বিশেষ এর মধ্যে পার্থক্য করে দেখিয়েছে যে, langue (ভাষা) এবং parole (বাক্য) আমাদের উপলব্ধির দুটো আলাদা স্তর। প্রথমটি বাক্যের গঠনকে নির্ধারন করে, কিন্তু বাক্যের মধ্যে প্রকাশিত হয়না (অর্থ্যাৎ বিমূর্ত)। বাক্যে যা প্রকাশিত হয়, তা হল বিশেষ ভাব (বাস্তব, বা এম্পিরিকেল), যা আবার শুধুমাত্র সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই সম্ভব (উপরের গোলাপফুল আর মানুষের উদাহরন দ্রষ্টব্য)। একই কথা কি লালনও বলছেন না? দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, Saussure প্রশ্নটা উত্থাপন করছেন abstract লেভেলে ভাষার বিচারে, আর লালন করছেন মানুষের বিচারে।
৩
আমার গবেষণাটা ছিল পরিচয়ের রাজনীতি (identity politics), যা কেবলমাত্র বিমূর্ত একটা ধারণা। আমরা সবাই জানি এবং উপলব্ধি করি এই পরিচয়ের রাজনীতি, কিন্তু বাস্তবে কখনোই আমরা পরিচয়ের রাজনীতি দেখিনা। যা' দেখি তা হলো সুনির্দিস্ট কোন না কোন পরিচয়ের রাজনীতি, যেমন বর্ণভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতি (color-based identity politics), ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতি (religion-based identity politics) , লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতি (gender-based identity politics), শ্রেণীভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতি (class-based identity politics), এলাকাভিত্তিক পরিচয়ের রাজনীতি (regional identity politics), ইত্যাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে উত্তরাধূনিক গবেষণা - নির্দিষ্ট করে বললে মিশেল ফুকো, এডোয়ার্ড সাইদ আর স্টিভেন সেইডম্যান - এর লেখালেখির দ্বারা উৎসাহিত হয়েছিলাম পরিচয়ের রাজনীতি পাঠে।
নিজের যাপিত জীবনের মধ্যে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা সমাজে প্রচলিত ধারণার প্রায়শঃই সাথে মিলত না। যেমন, আমার নানী আর মায়ের সাথে একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই জামালপুরের দুর্মুঠ নামক স্থানে শাহ কামালের (রঃ) মাজারে যেতাম সিন্নি দিতে। সেখানে কিছু লোককে দেখতাম বিবাগী-বেশে। বড়রা সব আমাকে সেসব লোকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলতেন কারণ ওরা কল্কি (গাঞ্জা) খায় এবং নানা রকম অপরাধে জড়িত হয় বলে। কিন্তু তাদেরকে কখনোই আমি কোন অপরাধে জড়াতে দেখিনি। বড়দের কাছ থেকে শোনা গাঞ্জাখোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার ধারণাটির প্রতি আমার অবিশ্বাস আরও দৃঢ়মূল হয় আমার ছোটবেলার বেশ কয়েকজন বন্ধু গাঞ্জাখোরদের সাথে মিশে নিজেরাও গাঞ্জাখোর নামে পরিচিত পেলে। দেখেছি তারা আর সব মানুষের মতোই দোষে-গুণে মিলিয়ে সাধারণ মানুষ। অথচ, গাঞ্জাখোর নামে পরিচিত হওয়ার জন্য তাদের নিয়ে নানারকম অকথা-কুকথা শোনা যেত, যেগুলো ছিল মূলত মানুষের সীমাহীন কল্পনার সাথে সামান্য সত্যের মিশেল। যেমন, হয়তো কোনদিন কোন এক গাঞ্জাখোর গ্যাস্ট্রিকের জন্য এন্টাসিড না কিনে সেই ওষুধের টাকায় গাঁজা কিনেছে। এটাকে অন্যান্যরা তার অজ্ঞতা এবং পাগলামি মনে করেছে। কেউ বা হয়তো ঘর থেকে সামান্য কিছু চাল চুরি করে বিক্রি করে গাঁজা কিনেছে। লোকে তাকে চোর বলেছে। অন্যান্যরা যখন মসজিদে নামাযের জামাতে যাচ্ছে, হয়ত দেখা গেল গাঞ্জাখোর কেউ সেদিকে না-গিয়ে যাচ্ছে গাঁজার আড্ডায়। মোটকথা, এরা এমন কিছু করেছে যা' অন্যদের থেকে ভিন্ন এবং অন্যদের চোখে অসামাজিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেখান থেকেই সমাজের জন-সাধারণের মনে এই ধারণার জন্ম যে, গাঞ্জাখোর অসামাজিক, অধার্মিক, অপরাধী। ক্রমাগতভাবে কল্পিত এইসব দোষগুলোকে তাদের উপর আরোপ করার মধ্য দিয়ে সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় যে, গাঞ্জাখোররা স্বভাবতঃই খারাপ, অসামাজিক, অপরাধী। অতএব, তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা দিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা একটা সামাজিক ও রাস্ট্রীয় দায়িত্ব।
আমার এই গবেষণায় গাঞ্জাখোরদের উপর নজর দিয়ে আমি বুঝতে চেয়েছি সমাজ কিভাবে একটা বিশেষ পরিচয় নির্মাণ করে এবং কিছু মানুষকে সে পরিচয়ে চিহ্নিত করে তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। একইভাবে, সমাজ তাদের উপর নানা রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করার মধ্য দিয়ে অন্যান্যদেরকেও অপ্রকাশ্যে এইকথা জানান দেয় যে, সমাজের শাসন না মানার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে (বউ মেরে ঝি শাসন করার মতো)। অর্থ্যাৎ, আমার এই গবেষণার মূলে ছিল সামাজিক পরিচয়ের রাজনীতির মধ্যে সমাজ (তথা স্বাস্থ্য, আইন, ধর্ম, নের্তৃত্ব) এবং চিহ্নিত ( প্রত্যক্ষভাবে, চিহ্নিত, এবং পরোক্ষে অন্যান্য সকল) ব্যক্তির ভূমিকার অনুসন্ধান। এই পরিচয়ের রাজনীতি একটা বিমূর্ত বিষয় যা বাস্তবে ধরা দিয়েছে গাঞ্জাখোর পরিচয়ের মধ্যে। একইভাবে এই পরিচয়ের রাজনীতি প্রকাশিত হয় ধর্মের রাজনীতিতে (মুসলিম/অমুসলিম), শিক্ষার রাজনীতিতে (মাদ্রাসা/কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়; অথবা পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়), জাতীয়তার রাজনীতিতে (মুক্তিযোদ্ধা/রাজাকার), বুদ্ধিজীবিতার রাজনীতিতে (বাম-প্রগতিশীল/ ডান-প্রতিক্রিয়াশীল)। অর্থ্যাৎ, আমার গবেষণার লক্ষ্যটি গাঞ্জাখোরদের উপর না-হয়ে উল্লিখিত যেকোন জনগোষ্ঠী নিয়ে হতে পারত। কাজেই, আমার প্রবন্ধটি পাঠে/আলোচনার মূলকেন্দ্র গাঞ্জাখোর নয়, বরং পরিচয়ের রাজনীতির মধ্যস্থিত সমাজ ও ব্যক্তি পারস্পারিক সম্পর্কের বোঝাপড়া।
পরিচয়ের রাজনীতির এই পাঠ থেকে আমি জেনেছি কিভাবে সমাজ ব্যক্তির উপর বিশেষ পরিচয় আরোপ করার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে। যেহেতু পরিচয়ের রাজনীতির বিমূর্ত ধারণাটা অবশ্যম্ভাবিরূপে একটা নির্দিষ্ট (অর্থ্যাৎ, বিশেষ) রূপে মধ্য দিয়ে বাস্তবে ধরা দেয়, আমাকে তাই এই গবেষণার জন্য উল্লিখিত অসংখ্য বিশেষ রূপের একটা (অর্থ্যাৎ, গাঞ্জাখোর) পাঠের মধ্য দিয়েই জ্ঞানটা অর্জন করতে হয়েছে। সামাজিক জীবনের সব গবেষণাই এমন – এখানে আমরা বাস্তব থেকে কোনকিছু বেছে নিই গবেষণার জন্য। কিন্তু লক্ষ্য থাকে সেই বিশেষ বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে অন্তর্নিহিত বিমূর্তকে বোঝা/উপলব্ধি করা।
বিমূর্ত (সাধারণ) এবং বিশেষ (বাস্তব) এর পার্থক্য মনে রাখলে গবেষণাভিত্তিক বই/প্রবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে সামাজিক সমস্যার বোঝাবুঝি নির্ভুল হয়।
Comments