নোটঃ ছবিটি প্রথম আলোর ২৭শে আগস্ট, ২০১৮ সংখ্যা থেকে সংগ্রহ করেছি।
১
বস্তুজগতে পদার্থের মূল যেমন অণু, সামাজিক জগতে সেই অণু হচ্ছে পরিবার। এজন্য পরিবার ভেঙে যাওয়া মানে গোটা সমাজব্যাবস্থাই ধ্বসে পড়া। অতএব, বর্তমানে বাংলাদেশে যে ব্যাপক হারে তালাক সংঘটিত হচ্ছে, তা অবশ্যই জাতীয় জীবনের জন্য একটা অশনিসংকেত। বাংলাদেশের তালাকের মহামারী আকার ধারণ করার বিষয়টি প্রথম গণমাধ্যমে ওঠে আসে ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে। যেমন, মার্চের ১৪ তারিখে সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকায় প্রকাশ- গত ছয় বছরে ঢাকা সিটিতে প্রায় ৩১ হাজার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে (বেড়েই চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদ)। আর চট্টগ্রামে ২০১৫ ও ২০১৬ এই দুই বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে ৭৪৪৭ যার মধ্যে ৭০% এরও অধিক আবেদনকারী ছিল নারী। কারণ হিসেবে আবেদনকারীরা দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অবহেলা, পারস্পারিক আস্থাহীনতা এবং পরকীয়ার কথা উল্লেখ করেছে। আর চট্টগ্রাম সিটির ম্যাজিস্ট্রেটের মত অনুসারে এর কারণ ইন্টারনেট ও মোবাইলের মাধ্যমে অবাধ মেলামেশার সুযোগ। একই তথ্য নিয়ে একই দিনে ভয়েস বাংলা নামের পত্রিকাতেও প্রতিবেদন এসেছে যার শিরোনামেই এর কারণ হিসেবে আস্থাহীনতা এবং পরকীয়া উল্লেখ করা হয়েছে (আস্থাহীনতার কারণে বেড়েই চলেছে বিয়ে বিচ্ছেদ)।
দৈনিক সমকাল এপ্রিলের ২৯ তারিখে বিয়ে বিচ্ছেদের উপরে একটা বেশ বড় কলেবরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে (বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদ )। এখানে ঢাকা সিটির তথ্যগুলো আরও বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায়। এখান থেকে জানা যায় যে, গত ছয় বছরে বিয়ে বিচ্ছেদের ৩৬৩৭১টি আবেদনের মধ্যে ২৪৮০৩টি, অর্থ্যাৎ ৬৮% ক্ষেত্রে আবেদনকারী হচ্ছে নারী। এইখানে কারণ হিসেবে ৮৭% বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পরকীয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ করা হয়েছে পারিবারিক কলহ, যৌন অক্ষমতা, মতের অমিল এবং তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার।
এই বিষয়ে মে মাসের ২১ তারিখে “তালাকের টর্নেডো” শিরোনামে সবথেকে চমক জাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক মানবজমিন (তালাকের টর্নেডো )। এখানে বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনে উপরে উল্লিখিত কারণগুলোর কথাই রয়েছে। তবে এখানে সিটি কর্পোরেশনের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলা হয়েছে যে, বিয়ে বিচ্ছেদর আবেদনে নারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণ নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা।
দৈনিক আজাদী পত্রিকার ৬ মে সংখ্যার একটা নিবন্ধ উল্লেখ করেছে যে, চট্টগ্রামের মেয়র পরিবারে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাকে মেয়েদের অধিক হারে তালাকের আবেদনের কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন (বিবাহ বিচ্ছেদকে বিদায় )।
বিয়ে বিচ্ছেদ বিষয়ে সংখ্যাগত উপাত্তের পাশাপাশি উপরের এইসব প্রতিবেদনে সংসার ভাঙ্গার যে কারণগুলো দেখলাম, এগুলো চিহ্নিত করেছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্টরা।
বিয়ে ও পরিবার সমাজের মূল ভিত্তি। আর এই বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতই বিশেষজ্ঞ মতামত। কাজেই, উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলো সমাজবিজ্ঞানীদের মতামতও সংযুক্ত করেছে এই সমস্যার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে। দেখি, এই বিশেষজ্ঞরা বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ ও ফলাফল নিয়ে কি বলেছেন।
মানবজমিনের প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসুদা রশীদ চৌধুরী বলেছেন, মেয়েরা আগের থেকে বেশি সামাজিক ও আর্থিক অধিকার পেয়েছে বলে তালাক দিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি উপরে উল্লিখিত কারণগুলোর কথাও বলেছেন। সমকালের প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সালমা আক্তার বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মেয়েদের শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার বৃদ্ধির কথা। একই প্রতিবেদনে ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নেহাল করীম বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের উল্লিখিত কারণগুলো পুণরাবৃতি করেছেন।
সময়ের কণ্ঠস্বর পত্রিকার প্রতিবেদনে একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অনুপম সেনের কাছ থেকে জানা গেছে যে, গ্রামসমাজ দ্রুত ভেঙ্গে নাগরিক সমাজে পরিণত হচ্ছে যেখানে মানুষ নাগরিক সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। পাশাপাশি নৈকট্য ও যোগাযোগের সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিয়ে বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনে অধ্যাপক অনুপম সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে নারীদের আর্থিক স্বাধীনতাকে তালাকের হার বৃদ্ধির কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা আর সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ দারুন মিল - দুইপক্ষই কারণ হিসেবে পরকীয়া ও তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের পাশাপাশি পারিবারিক বোঝাপড়ার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা, ইত্যাদির উল্লেখ করেছে। এমনকি নারীদের অধিক হারে তালাকের আবেদনের কারণ হিসেবেও দুই পক্ষই নারীর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উল্লেখ করেছে!
আমি অবাক হয়েছি দুইটা কারণে। এক, সমাজবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অধ্যাপকরা যেভাবে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ বিশ্লেষণ করলেন, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও একই বিশ্লেষণ করলেন, সমাজবিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রী ছাড়াই। প্রকৃতপক্ষে, মোটামুটি সাধারণজ্ঞান সম্পন্ন যেকোন ব্যক্তিকে বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ জিজ্ঞেস করলেও একই রকম উত্তর পাবো বলে আমার ধারণা। তাহলে কি ধরে নিবো যে, সমাজবিজ্ঞান আর সাধারণজ্ঞানের মধ্যে কোন ফারাক নাই? - ফারাক অবশ্যই আছে। অর্থাৎ, বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, এগুলো সাধারণজ্ঞানপ্রসূত, কোন প্রকার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নয়।
দুই, নারীর আর্থিক স্বাধীনতার বৃদ্ধিই যদি তাদের অধিক হারে তালাকের জন্য আবেদন করার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ত এটাই সত্য যে, নারী বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয় নিজেদের আর্থিক স্বাধীনতার অভাবে। এক্ষেত্রে তসলিমা নাসরীন ত ঠিকই বলেছিল যে, “বিয়ে হলো নারীর জন্য শৃংখলস্বরূপ। এই শৃংখল ভাঙতে হবে” (নির্বাচিত কলাম, সাপ্তাহিক যায়যায়দিন, সন-তারিখ মনে নাই)।
উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলো তালাকের সমস্যা সমাধানের জন্য সাংবাদিকরা স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের কাছেই গেছে। বিয়ে-বিচ্ছেদ রোধের জন্য এই বিশেষজ্ঞরা সামাজিক দায়বদ্ধতা, পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা আর পারস্পারিক বিশ্বাস বৃদ্ধি, পারিবারিক সম্মানবোধ, এবং আত্মসচেতনতার উল্লেখ করেছেন।
এখন দেখা যাক, বিশেষজ্ঞদের অনুসরণ করে কিভাবে দেশে আশংকাজনক হারে বর্ধিষ্ণু বিয়ে বিচ্ছেদের সমস্যার সমাধান করা যাবে।
আমরা জানি, যেকোন সমস্যার সমাধানের জন্য সবার আগে দরকার তার কারণ নির্ণয় করা। এরপর সেই কারণকে দূর করার মাধ্যমে সমস্যা নির্মূল করা। যেমন, চিকনগুনিয়ার জন্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এক প্রজাতির মশার কামড়কে। আর তাই প্রতিকার হিসেবে সেই মশাকে নির্বংশ করতে হচ্ছে। ভাইরাস জ্বর হলে সেই ভাইরাসকে মেরে জ্বর সাড়ানো হচ্ছে। উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলোতে বিয়ে বিচ্ছেদের যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।
এক, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন তথা তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার এবং এর মাধ্যমে পরকীয়া;
দুই, পারিবারিক সমঝোতার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা ও অনীহা;
এবং তিন, নারীর ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং ফলস্বরূপ আত্মনির্ভরশীলতা।
যুক্তিসঙ্গতভাবেই, বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকানোর জন্য আমাদেরকে এর কারণগুলো দূর করতে হবে। অর্থ্যাৎ, আমাদেরকে যে যে ব্যবস্থা নিতে হবে, সেগুলো হলো-
এক, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরকীয়ার সুযোগ বন্ধ করা;
দুই, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা; এবং তিন, নারীর স্বাধীনতা সীমিত করার মাধ্যমে তাদেরকে পুরুষ/স্বামীর উপর নির্ভরশীল করে তোলা।
পাঠক, বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবনা অনুসরণ করে বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশের কি হাল হবে, অনুমান করতে পারছেন? ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের উপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে, ধর্মীয় ও সামাজিক নীতি শিক্ষার উপর ব্যাপক জোর দিতে হবে, এবং মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে হবে। সেই দেশের চেহারাটা কেমন হবে? তালেবানী আফগানিস্তানের মতো, ঠিক?
আমরা নিশ্চয়ই পেছনে ফিরে যেতে চাইনা, তালেবানী আফগানিস্তানে ত আলবৎ না। তাহলে কি ক্রমবর্ধমান বিয়ে বিচ্ছেদের মধ্যে বাস করাই বাংলাদেশের নগর সমাজের অমোঘ নিয়তি?
প্রকৃতপক্ষে, বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ ও প্রতিকার নির্ণয়ে আমাদের বাংলাদেশের মিডিয়া এবং সমাজবিজ্ঞানীরা যে ধারণা পোষণ করছে, সেগুলো না বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, আর না সঠিক বিশ্লেষণ। তাহলে এই সমস্যার সঠিক বিশ্লেষণ কি? এর সমাধানই বা কোন পথে?
২
সমাবিজ্ঞানে প্রচলিত গবেষণা রীতি অনুযায়ী ব্যাক্তির যেকোন সমস্যাকে স্থান (সমাজের সামগ্রিকতার মাঝে ব্যক্তিজীবন) বা কালের (ঘটে যাওয়া অতীতের ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটে বর্তমান) পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করা হয়, যাকে এক কথায় বলা হয় ‘সোসিওলজিক্যাল ইমাজিনেশন’ বা সমাজতাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের বিদ্যমান তালাক ও পরিবার ভাঙনের সমস্যার একটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছি।
তালাক নিয়ে আলোচ্য সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর সবগুলোতে দেখা যায় যে, আবেদনকারীরা (উল্লেখ্য, এদের ৭০ শতাংশ নারী) সঙ্গীর মধ্যে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অবহেলা, পারস্পরিক আস্থাহীনতা ও বোঝাপড়ার অভাব এবং পরকীয়াকে তালাকের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (এসব প্রতিবেদন সিটি মেয়র ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকের বরাতে আরো যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন, সেগুলো বাদ দিয়ে তালাকের আবেদনকারীদের উল্লেখিত কারণগুলোকে বিবেচনা করছি। কারণ সেগুলো তথ্য নয়, বরং অযৌক্তিক মতামত এবং ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ)।
‘দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অবহেলা’র অভিযোগ উঠতে পারে, যদি পরিবারের স্বামী/স্ত্রী আমাদের সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি অনুসারে আর্থিক, সামাজিক ও দৈনন্দিন ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হয়। সাধারণত, স্বামীর দায়িত্ব হলো সংসারের ভরণ-পোষণ ছাড়াও সন্তানের পড়াশুনা এবং নানাবিধ দেখভাল করা আর স্ত্রীর ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনের পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করা এবং অন্যান্য সামাজিকতা করা। এসব রীতিনীতি সমাজ কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা পরিবারের উপর হঠাৎ একদিনে চাপিয়ে দেয়নি। বরং বংশ পরম্পরায় যুগের পর যুগ ধরে নানাবিধ বাস্তব প্রয়োজনে এসবের উৎপত্তি ও প্রচলন হয়েছে। আমাদের সমাজে ব্যাক্তি নির্বিশেষে সবাই এসব রীতিনীতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছে।
কিন্তু আধুনিক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে, আমাদের সমাজ পরিবর্তনের গতি ও প্রকৃতি সামাজিক বাস্তবতাকে প্রচলিত রীতিনীতির সঙ্গে ক্রমাগত অসামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে নানাভাবে এই অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়বে। আমি শুধু একটি উদাহরণ দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা ব্যাখ্যার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই কৃষিভিত্তিক সমাজ, যেখানে সবাই একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করে। আশির দশকেও বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসতো কৃষি থেকে এবং জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি সরাসরি কৃষিতে নির্ভরশীল ছিল। সেই সমাজে পরিবারের সবাই মিলে জমিতে কৃষি/অথবা ব্যাবসার মাধ্যমে আয়- রোজগার করত, সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালন করত, অন্য সব সামাজিকতা করত। ফলে কর্তব্য বা দায় যা কিছু ছিল, সবই ছিলো মূলত সম্মিলিতভাবে পারিবারিক।
কিন্তু বর্তমানে সে বাস্তবতা অনেকখানি বদলে গেছে। এখন জাতীয় আয়ের মাত্র ১৪ দশমিক ৭৯ (২০১৬-১৭ অর্থবছর) শতাংশের মত আসে কৃষি থেকে। শুধু কৃষিকাজ থেকে আর জীবনধারণের উপায় নেই। ফলে শিক্ষা লাভ করে একান্নবর্তী পরিবার থেকে বের হয়ে ব্যক্তি দূর-দূরান্তরে চলে যাচ্ছে চাকরি বা ব্যাবসার কারণে, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে স্ত্রী ও সন্তানদের। পরিবারের ভরণ-পোষণ, গৃহস্থালির ব্যাবস্থাপনা, সন্তানদের লালন-পালন, ইত্যাদি দায়িত্ব পালনে পরিবারের সম্মিলিত ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে ব্যাক্তিকে, একাকী। সামাজিক প্রচলিত রীতিনীতি কিন্তু আগের মতই আছে। যেমন, সাধ্যে না কুলালেও পরিবারের স্ট্যাটাস অনুযায়ী খরচ করার মত অর্থ রোজগার করতেই হয়। পোশাকে-আশাকে, চালচলনে ঠাটবাট বজায় রাখতেই হয়। দশজনের দায়িত্ব ও কর্তব্য একজনের কাঁধে পড়লে, তা সে নারী-পুরুষ যে-ই হোক, ব্যার্থ হবেই। সেটা হচ্ছেও।
এরপর দেখা যাক ‘পারস্পরিক আস্থাহীনতা ও বোঝাপড়ার অভাব’ অভিযোগটি। নারী ও পুরুষ উভয়েই নানা স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধে একত্রে সেসব স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করবে বলে। কিন্তু উপরে ব্যাখ্যা করলাম কেন বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একাকী ব্যাক্তির পক্ষে পারিবারিক জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা অসম্ভব। ফলে স্বভাবতই স্বামী-স্ত্রীর কল্পনা আর প্রাপ্তির মাঝে ফারাক দেখা দেয়, যা ক্রমাগতভাবে বাড়তেই থাকে। প্রত্যাশা পুরণে ক্রমাগত ব্যর্থতার একপর্যায়ে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেউ একজন অথবা উভয়েই সঙ্গীর উপর আস্থাহীন হয়ে পড়ে। ফলে পারস্পরিক পরামর্শের স্থান দখল করে বোঝাপড়ার অভাব। বাজার, রান্না, ঘুরাঘুরি ইত্যকার যেকোন দৈনন্দিন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে তাকালেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর সঙ্গীর উপর থেকে এ আস্থা যখন বিলীন হয়ে যায় যে, সে লালিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত করতে পারবে না, তখন অন্য কাউকে তেমন সামর্থ্যসম্পন্ন মনে হলে বিদ্যমান সঙ্গীকে ত্যাগ করে নতুন করে জুটি বাঁধা একটি সম্ভাব্য ফলাফল বৈকি। ঘটনার পরিক্রমায় শুরু হয় পরকীয়া বা পরকীয়ার সন্দেহ। শেষ দৃশ্যে তালাকের আবেদন ও বিবাহ বিচ্ছেদ।
৩
পরিবর্তন ঘটেছে শুধু আর্থসামাজিক কাঠামোতেই নয়, বিয়ে এবং পরিবারের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আর এর কেন্দ্রে রয়েছে ভালোবাসা-নির্ভর ব্যক্তিগত পছন্দে বিয়ের মাধ্যমে একক পরিবার গড়ার প্রবণতা
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজে যুগ যুগ ধরে বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠনের রীতি অনুসরণ করা হয়, যেখানে দুটি পরিবার, কখনো বা গোত্র/গোষ্ঠী দুজন তরুন-তরুনীকে জোড় বেঁধে দেয়। এখানে ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ গৌণ, পরিবারের ইচ্ছাই মূখ্য। কাজেই ব্যক্তিগত ভালোবাসাও হিসেবের বাইরে। বিভিন্ন সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিয়ে ও পরিবারের বিশ্বজনীন রূপ এইটাই।
ভালোবাসার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের সমান পুরনো। কিন্তু ভালোবাসার ভিত্তিতে বিয়ে মাত্র ৫০ বছর আগের।
রোমান্টিক ভালোবাসা এবং সেখান থেকে বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে একক পরিবার, যেখানে স্বামী উপার্জনকারী আর স্ত্রী গৃহস্থালীর ব্যাপস্থাপক। এমন পরিবারের উদ্ভব হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি, ভোগবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মিলেমিশে এ ধরণের বিয়ে এবং পরিবারকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে যা, ক্রমশ সমগ্র পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে। স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত নৈকট্য এবং যৌনতৃপ্তিসহ আর সব চাহিদা ও আশা-আকাঙ্খা পূরণ এই পরিবারের মূল লক্ষ্য। আগেকার পরিবারকেন্দ্রিক বিয়েতে যেখানে মূল লক্ষ্য ছিল নৈতিকতা এবং পরিবারের তথা সমাজের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য, এই পরিবারে তা ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি।
কিন্তু ব্যক্তির সন্তুষ্টির লক্ষ্যে গড়া এই একক পরিবারের ভিত্তিমূলে রোমান্টিক ভালোবাসা নিয়ে আসাটা ধ্বংসাত্মক বলে প্রতীয়মান হতে খুব একটা দেরী হলো না। একান্নবর্তী/যৌথ পরিবারের মাধ্যমে এ্যারেঞ্জড বিয়েতে সমগ্র পরিবারের অংশগ্রহণ থাকে— বিয়ে থেকে শুরু করে আয় উপার্জন, গৃহস্থালি, সন্তান লালন-পালন, বিনোদন, সামাজিকতা, ইত্যাদির সবকিছুতে। কিন্তু একক পরিবারে সবকিছু করতে হয় স্বামী ও স্ত্রীকে, কারো সাহায্য ছাড়া।
অনেকের দায়িত্ব একজনের উপর এসে পড়ে বলে এই একক পরিবার স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙ্গে পড়ে, যেমন ভেঙ্গে পড়ে একতালা ফাউন্ডেশনের উপর তৈরি করা বহুতল ভবন। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই রোমান্সের জগৎ থেকে কঠিন বাস্তবে নেমে আসে নবদম্পতি। দুজনের একসাথে দেখা স্বপ্নগুলো একে একে ভেঙ্গে যেতে থাকে। ফলস্বরুপ, নানা টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে তারা ক্রমাগত বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যায়।
উদ্ভবের মাত্র দুই দশকের মাঝেই আমেরিকায় একক পরিবার এতো ব্যাপক হারে ভেঙ্গে যেতে থাকে যে, পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য গড়ে ওঠে বিয়ে বিচ্ছেদ প্রতিরোধ-বিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের শতশত এজেন্সী। কিন্তু প্রায় চার দশক ধরে কাজ করেও এরা আমেরিকার বিয়ে বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি। কারণ এরা সমস্যার গোড়ায়, তথা ব্যক্তির সাধ্যাতীত দায়িত্ব/আশা/আকাঙ্খা পূরণের দায়িত্বকে সম্মিলিত সামাজিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর কাঁধে তুলে দিয়েছে।
এটা একটা সাধারণ জ্ঞান যে, একতলার ফাউন্ডেশনের উপর দশতলা দালান তৈরি করলে সেটা ভেঙ্গে পড়বে, একজনের কাঁধে দশমণ ওজনের বোঝা দিলে সে ব্যার্থ হবে। রোমান্টিক ভালোবাসাভিত্তিক বিয়ের মাধ্যমে গঠিত পরিবারের মধ্যে বিয়ে-বিচ্ছেদের ব্যাপারটিও ঠিক একই রকম।
পরিবারের জন্য উপার্জন করতে স্বামী দিনমান পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতেই যাবে, স্ত্রীর সঙ্গে টিভিরুমে বসে সিরিয়াল দেখবে না, কিংবা জানালার ধারে বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কবিতা বলবে না। বরং চিন্তা করবে আগামী দিনের কাজগুলো কিভাবে করবে, আয়-উপার্জন বাড়িয়ে সংসারে আরো কিভাবে স্বচ্ছলতা আনবে। আবার সন্তানদের নাইয়ে-খাইয়ে স্কুলে দিয়ে এসে, ঘরদোর পরিষ্কার করে সারা দিনের জন্য রান্না-বান্না করে আবার সন্তানদের স্কুল থেকে নিয়ে এসে হোমওয়ার্ক দেখিয়ে রাতের খাবার খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়ানোর মধ্য দিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত স্ত্রীর মুখে বিয়ের আগের প্রেমময় অভিব্যাক্তি দেখার আশা করাও অবাস্তব।
রোমান্টিক ভালোবাসা সত্য, কিন্তু পরিবারের মত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হিসেবে অযৌক্তিক এবং ভঙ্গুর। এটি কল্পনার জগতে ব্যক্তিকে রাজারাণী বানাতে পারলেও বাস্তবে সামর্থ্যের অতীত দায়িত্ব-কর্তব্য চাপিয়ে দিয়ে কার্যত ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। আর তাই বিয়ের ভিত্তি হিসেবে রোমান্টিক ভালোবাসা কখনই গ্রহণযোগ্য বিবেচ্য হয়নি, কোন সমাজেই না। যেমন—প্রাচীন ভারতবর্ষে ভালোবাসাকে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী অসামাজিক কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হতো। গ্রিকরা ভালোবাসাকে মনে করতো এক ধরণের মানসিক রোগ, যে ধারণা মধ্যযুগে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ফ্রান্সে ভালোবাসাকে মনে করা হতো মনোবৈকল্য রোগ, যার ঔষধ ছিলো ভালোবাসার ব্যক্তি বা অন্য কারো সাথে যথাসম্ভব দ্রুত যৌন সংসর্গ করা, যাতে রোগ তাড়াতাড়ি সেরে যায়। চীন দেশে বাবা-মা পুত্রকে বাধ্য করত পুত্রবধূকে তালাক দিতে, যদি তার ব্যাবহার বা কাজকর্ম আশানুরূপ না হতো। এক্ষেত্রে স্ত্রীর প্রতি পুত্রের ভালোবাসা বিবেচ্যই ছিলো না। চৈনিক ভাষায় ভালোবাসা শব্দটিই ছিল না; এর কাছাকাছি একটি শব্দ ছিল যার অর্থ ছিল বেআইনি ও অসামাজিক সম্পর্ক। ১২ ও ১৩ শতকে ইউরোপে আদর্শ ভালোবাসা বলতে বোঝাতো সমাজের উচ্চশ্রেণীতে বিবাহ সম্পর্ক-বহির্ভূত দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক। প্রকৃত ভালোবাসার প্রথম শর্তই ছিল দুজন বিবাহিত হবে না। ইউরোপের মধ্য ও নিম্নশ্রেণীতেও ভালোবাসাকে পরিবারের বাইরের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতো, যা তাদের নানা জনপ্রিয় গান ও গল্পকথার মাধ্যমে দাম্পত্য ভালোবাসাকে ব্যঙ্গ করার মধ্যে দৃশ্যমান। অর্থাৎ, যুগে যুগে মানব সমাজে ভালোবাসা ছিল ঠিকই, কিন্তু তার ভিত্তিতে পরিবার গঠন করার রীতি ছিল না। বরং সেই ভালোবাসাকে রাখা হতো পরিবারের বাইরে। কারণ, পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হিসেবে ভালোবাসা দূর্বল ও ভঙ্গুর।
৪
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল দেশেই যেখানে সমাজ বিয়ের ভিত্তি হিসেবে ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছে, সেখানেই বিয়ে বিচ্ছেদের মহামারী লেগেছে। বাংলাদেশেও একই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করছি আমরা। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমস্যার মূল কারণ, তথা ভালোবাসার ভিত্তিতে বিয়ের ধারা থেকে সরে এসে পরিবারের উপর দায়িত্ব-কর্তব্যের ওপর জোর দিতে হবে। বিয়ের আগে ভালোবাসার মানুষের সাথে হররোজ ডেটিং করলেও বিয়ের সময় মনে রাখতে হবে যে, পরিবার মূলত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার ভেতর দিয়ে সমাজ ব্যক্তির উপর সমাজকেই প্রতিপালন করার দায়িত্ব আরোপ করে—নতুন প্রজন্মের জন্মদান, লালন পালন এবং সমাজের সদস্য হিসেবে যাবতীয় রীতিনীতি ও জ্ঞানের শিক্ষাদান, বড়দের সেবা ও সমগ্র পরিবারের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে সমাজকে চলমান রাখা।
পরিবার মূলত একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে নানা রীতিনীতি অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার উপর অর্পিত সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে। যেহেতু সেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অন্য আরো অনেকের সহযোগিতা আবশ্যক, তাই সমাজ ব্যক্তিকে এমন পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে, যেখানে ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো মেটানোর পাশাপাশি অন্যদের সহায়তায় সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্যগুলোও পালন করা সম্ভব হয়। আর এমন সহযোগিতামূলক পরিবারের ভিত্তি হল পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ।
নোটঃ লেখাটি খানিকটা সংক্ষিপ্ত কলেবরে দৈনিক বণিকবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট।
Comments