গ্রন্থসূত্রঃ Understanding Social Dynamics in South Asia: Essays in Memory of Ramkrishna Mukherjee, edited by Partha Nath Mukherji, N. Jayaram, Bhola Nath Ghosh, Springer, 2019
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় পরিচয়ের রাজনীতিতে বিশেষ করে ইসলামের ভূমিকা এবং অবস্থান আমার একাডেমিক আগ্রহের অন্যতম বিষয়। বেশ কয়েক বছর যাবৎ এই বিষয়ে পড়াশোনা করছি। সম্প্রতি “The Ethno-class Formation and Contemporary National Identity in Bangladesh” একটা প্রবন্ধ পড়লাম। এটি Springer পাবলিশিং থেকে ২০১৯ প্রকাশিত Understanding Social Dynamics in South Asia: Essays in Memory of Ramkrishna Mukherjee গ্রন্থের একটা অধ্যায়। যথারীতি আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।
প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে এই বলে যে, এটি “examines the relationship between ethnographic-class formation of Bengali-Muslims and the fluidity of their national identity. In particular, we focus on the role of uneven economic development and internal colonialism during the formation of ethnographic-classes in Bengal and Bangladesh” (p.214). ভূমিকায় লেখক দাবী করেছেন যে, বাঙালি-মুসলমানের এথনিক পরিচয় ছিল কল্পিত (imagined), আবিষ্কৃত (invented) এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী (instrumental)। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে যে ইসলামী পূণর্জাগরণ দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে এথনো-ক্লাস পরিগঠনের Lumpen বা ছ্যাঁচ্চোর স্বভাব। এরপর প্রবন্ধের পাঁচটি অংশে লেখক আর্যদের সময় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পর্যাক্রমিক হিন্দু-মুসলিম বিভাজন, সেখান থেকে তাদের মধ্যে সমন্বয়, এবং সবশেষে পাকিস্তান আমলে পশ্চিম-পূর্ব পাকিস্তানী বিভাজনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের জাতীয় পরিচয়ের উদ্ভব ও বিকাশ নির্ণয়ের প্রয়াস পেয়েছেন।
গবেষণা-প্রবন্ধের রীতি অনুযায়ী প্রথমেই গবেষণা-প্রশ্ন উত্থাপন করার কথা যা এই প্রবন্ধে রয়েছে। কিন্তু তারপর থেকেই এর সীমাবদ্ধতাগুলোর শুরু। এইখানে মূল কনসেপ্ট হল দুটো - বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এথনো-ক্লাস ফরমেশন/গঠন এবং তাদের জাতীয় পরিচয়। প্রবন্ধের শুরু, শেষ, মধ্যাংশ কোথাও ‘এথনো-ক্লাস’ কনসেপ্টের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফলে লেখক এথনো-ক্লাস বলতে কি বুঝিয়েছেন তা’ অস্পষ্ট। এজন্য বাঙালি মুসলমান সমাজকে ঔতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে কিভাবে তার উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করা হলো তা কোথাও স্পষ্ট নয়।
বিশ্লেষণের অন্যতম মাধ্যম হলো কনসেপ্ট। প্রবন্ধের সর্বত্র নানান কনসেপ্টের ব্যবহার দেখা গেছে। কিন্তু অধিকাংশ কনসেপ্টের সংজ্ঞা, কাঠামো এবং এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়সারা ভাব লক্ষ্যণীয়। যেমন, আর্য এবং তুর্ক-আফগান শাসনামলকে বলা হয়েছে কলোনিয়ালিজম, আবার বৃটিশ শাসনামলকেও। প্রথমতঃ কলোনিয়ালিজম হিসেবে বৃটিশ শাসনামল স্বীকৃত। আর এর সাথে তুলনীয় ছিল বাংলার মুঘল শাসন, যেখানে শাসকগোষ্ঠী বাংলা থেকে শাসনকাঠামোর মধ্য দিয়ে বাংলার সম্পদ বাইরে স্থানান্তর করত। কিন্তু তুর্ক-আফগান শাসন সেই অর্থে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল। আবার আর্যদের সময় বাংলা যেরূপে ছিল, তাকে আজকের বাংলার পূর্বসূরি বলা গেলেও সেখানে এখনকার কলোনিয়ালিজম আরোপ করা নানান বিবেচনায় অনৈতিহাসিক।
কনসেপ্টের সুনিদিষ্ট সংজ্ঞা এবং বিশ্লেষণের মধ্যে তার যথাযথ প্রয়োগ গবেষণা-প্রবন্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি। এই প্রবন্ধে কনসেপ্টকে দায়সারাভাবে ব্যবহার করার একটা উদাহরণ হলো কলোনিয়ালিজম কনসেপ্টের মাধ্যমে লেখক বাঙলায় আর্যদের সময় হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, তুর্ক-আফগান আমলে সমন্বয়, আবার বৃটিশ আমলে বিভাজন ব্যাখ্যা করেছেন। অনুরূপভাবে নিওলিবারেলিজমের মধ্যে বাংলাদেশে লুম্পেন শ্রেণীর উদ্ভবের আলাপকে অকস্মাৎ বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশের মধ্যে নিয়ে এসে কিভাবে এথনো-ক্লাসের ব্যাখ্যা করলেও। তা-ও স্পষ্ট নয়।
সমাজ গবেষণায় আলোচ্য বিষয়কে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক (স্থান এবং কালপর্ব) প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই প্রবন্ধে ইতিহাসকে খণ্ডিত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে আর্গুমেন্টকে সমর্থনের জন্য। গুরুত্বপূর্ন তথ্যের অনুপস্থিতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উপস্থাপিত তথ্যের ভুল ব্যাখ্যা গবেষণার প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে সহায়তা করার বদলে আরও ধোঁয়াশায় ফেলে। যেমন, লেখক আর্য আমলে বাঙ্গাল-বাঙালি বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাঙ্গাল শব্দটি এবং বাঙ্গাল বলে পরিচিত জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব আর্যদের কয়েকশ বছর পরে হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা একমত পোষণ করেন। আবার বৃটিশ আমলে ইংরেজদের ভূমি সংস্কার এবং ইংরেজি শিক্ষার উল্লেখ করে দেখাতে চেয়েছেন যে, সমাজকাঠামোয় উচ্চ অবস্থানে থাকায় হিন্দুরা এসবের সুফল ভোগ করেছে আর নিম্ন অবস্থানে থাকার কারণে মুসলমানরা বঞ্চিত হয়েছে। যেকোন গবেষণাকে সমাজবিজ্ঞানসম্মত হতে হলে অবশ্যই হিন্দু-মসলমানের এই তুলনামূলক অসম সামাজিক অবস্থানের উৎপত্তি ও বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করতে হবে, যা এই প্রবন্ধে অনুপস্থিত।
কনসেপ্টেসমূহের অস্পষ্টতা এবং স্থানে স্থানে সেসবের প্রয়োগে স্ববিরোধীতা, ঐতিহাসিক ধারার ক্রুটিপূর্ণ বর্ণনা আর যথাযথ যুক্তির অভাব এই প্রবন্ধের বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্তিপূর্ণ করেছে। উত্থাপিত প্রশ্ন তথা বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয়ে কিভাবে তাদের এথনো-ক্লাস ফরমেশন প্রভাব বিস্তার করেছে তার কোন উত্তর পাওয়া যায় না প্রবন্ধের কোনখানেই। বিশ্লেষণের ফলাফল হিসেবে যে উত্তর দেওয়া হয়েছে তা’ হলো “বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইসলামি পূনর্জাগরণ” আর এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিদ্যমান এথনো-ক্লাস ফরমেশনের লুম্পেন বৈশিষ্ট্যকে।
অর্থ্যাৎ, প্রবন্ধের ভূমিকাতে লেখক যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে উত্তর প্রমাণ করবেন বলে উল্লেখ করেছেন, তার সাথে প্রবন্ধের বিশ্লেষণের যথাযথ যোগসূত্র নাই। এর কারণগুলো হলো নিম্নরূপঃ
১। সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত গবেষণা রীতি মোতাবেক কনসেপ্টেসমূহের সঠিক ও সুনির্দিষ্ট অর্থ নিরূপণ এবং প্রয়োগের অভাব। আর মূল কনসেপ্ট তথা এথনো-ক্লাস এবং জাতীয় পরিচয়কে কিভাবে ব্যবহার ও প্রয়োগ করা হয়েছে তা লক্ষ্য করলেই বোঝা সম্ভব কেন এই প্রবন্ধ উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
২। গবেষকের বাংলার মুসলমান সমাজের ইতিহাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জানাশোনার অভাব। যতটুকু তিনি উপস্থাপন করেছেন তা’ আজ থেকে চল্লিশ বছর বা তারও অধিক আগের। বাঙালি মুসলমানের পরিচয়, বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও বিকাশ এবং এর সাথে ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে বিগত দুই দশকে ৩০টিরও অধিক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে যার কোনটিকেই দেখলাম না এই প্রবন্ধে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে জাতীয়তাবাদের আলোচনায় রাফিউদ্দীন আহমেদ (১৯৮১), অসীম রায় (১৯৮৩), রিচার্ড ইটন (১৯৯৩), জয়া চ্যাটার্জি (১৯৯৪) আর সাম্প্রতিক সময়ে নিলেশ বোসের (২০১৪) আর ইফতেখার ইকবালের (২০০৯) গবেষণার সাথে যুক্ত না-হলে সেই বিশ্লেষণ অনিবার্যভাবেই অসম্পূর্ণ হবে। সেক্ষেত্রে (ক) বিশ্লেষণে গোঁজামিল দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা, যা আলোচ্য প্রবন্ধে লক্ষ্যণীয়। যেমন, রামকৃষ্ণ মুখার্জির ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান জাতিবর্ণ প্রথার উদ্ধৃতি দিয়ে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লেখক দাবী করেছেন যে, “this was exactly the situation for class and ethnic identity of Bengal muslim” (পৃ.২১৪)। লেখকের এই দাবীর পক্ষে না আছে কোন রেফারেন্স, আর না তার নিজের কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা। মুখার্জির উদ্ধৃতির পরপরই দেখি প্রখ্যাত তিনজন সামাজিক বিজ্ঞানীর প্রদত্ত তিনটি কনসেপ্টের উল্লেখ, যা’ লেখকের অসমর্থিত দাবী (তথা বাঙালি মুসলমান সমাজ সর্বভারতীয় সমাজের মতোই জাতিবর্ণ ভেদে বিভক্ত ছিল) থেকে পাঠকের মনোযোগকে বিচ্যুত করা ছাড়া আর কিছু করেনা।
(খ) আলোচনার সাথে সম্পর্কহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক রেফারেন্স যুক্ত করাটাও যুক্তি-প্রমাণের অভাবকে চিহ্নিত করতে পারার ক্ষেত্রে একটা বাঁধা। রামকৃষ্ণ মুখার্জির থেকে করা উদ্ধৃতির অধিকাংশ, করীম, মার্ক্স, অন্যান্য পশ্চিমা স্কলারদের নাম উদ্ধৃতি করাটা রেফারেন্সের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া প্রবন্ধের না-কোন দাবিকে সমর্থন করেছে, না কোন সমস্যাকে ব্যাখ্যা করেছে। সর্বোপরি, কিছু কিছু কোটেশনকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন, ইটনের বইয়ের ফোকাস হলো মুঘল আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ যাকে বাদ দিয়ে লেখক ইটনের বরাতে প্রাক-মুঘল বাংলায় বাঙালি-বাঙ্গাল বিভেদ নির্দেশ করেছেন। অথচ, ইটনের গবেষণা যথাযথভাবে পড়লে বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে লেখক বেশ যুক্তিযুক্ত আলোচনা উপস্থাপন করতে পারতেন। একইভাবে, হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের আলাপে অসীম রায় বা জয়া চ্যাটার্জির বিশ্লেষণের সাথে যুক্ত না-হওয়াটা এই আলোচনায় একটা বড় দূর্বলতা।
(গ) একাডেমিক জার্গন বা কঠিন পারিভাষিক শব্দের যথেচ্ছ প্রয়োগ প্রবন্ধের বিশ্লেষণকে সাধারণ পাঠকের পক্ষে অনুসরণ করা এবং বোঝার ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। প্রবন্ধের প্রতিটি সাব-সেকশনে লেখক বিভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে এসেছেন যার কোনটাই তিনি স্পষ্ট করে ডিফাইন/সংজ্ঞায়িত করেন নাই। কলোনাইজেশন, এরাবাইজেশন, এথনিক আইডেন্টিটি, এথনো-ক্লাস ফরমেশন, নিওলিবারেলাইজেশন, পলিটিকেল ইসলাম, মিলিট্যান্ট ইসলাম, ইত্যাদি কোনটার সংজ্ঞা দেওয়া হয় নাই। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এনালিটিক্যাল কনসেপ্ট হিসেবে। ফলে আলোচ্য প্রশ্ন থেকে দূরে সরে গিয়ে বিশ্লেষণ চলেছে নানান অভিমুখে।
(ঘ) সবশেষে, প্রবন্ধের শেষ অংশে এসে নিওলিবারেলিজম কিভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজকাঠামোকে প্রভাবিত করল, এবং সেইখান থেকে গ্লোবালাইজেশনের (নির্দিষ্ট করে, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিকদের মাইগ্রেশন) মধ্য দিয়ে বহিরাগত “পলিটিকেল ইসলাম” কিভাবে বাংলাদেশে নতুনরূপে ইসলামাইজেশন ঘটালো সেই আলাপ কোথা থেকে এলো, কেনই বা এলো, আর কিভাবে তা মূল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে তার কোন হদিস পাওয়া গেলনা।
মোটের উপর, আলোচ্য প্রবন্ধটি লেখকের প্রস্তাবিত প্রশ্ন তথা বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয়ের উদ্ভব ও বিকাশে তাদের “এথনো-ক্লাস” (কনসেপ্টটা ব্র্যাকেটে রাখলাম কারণ আমি বুঝিনি এই দিয়ে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন) ফরমেশনের ভূমিকা বিশ্লেষণে ব্যর্থ। এর মধ্যে উল্লিখিত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠলেই কেবল এটি আন্তর্জাতিক মানের (ব্লাইন্ড পিয়ার-রিভিয়ড) জার্নালে প্রকাশের যোগ্য একটা প্রবন্ধ হয়ে উঠতে পারে।
.....................
আমি যে প্রবন্ধটি পর্যালোচনা করলাম, সেটা বর্তমানে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিনের লেখা। এই প্রবন্ধটি নিয়ে আমার মূল্যায়ন যা, তাতে এটি প্রকাশযোগ্য করতে হলে লেখককে আলোচ্য বিষয়ে বেশ অনেকটা পড়াশোনা করতে হবে, এবিষয়ে সাম্প্রতিক প্রকাশনাগুলোকে পড়ে চলমান বিতর্কের নানান দিকে নতুন তত্ত্বের ও তথ্যের সংযোজন, সেসবের সীমাবদ্ধতা, সেসব থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে নিজস্ব অবস্থান নির্ণয় করতে হবে, এবং তার ভিত্তিতে একাডেমিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বীয় ও পদ্ধতিগত কাঠামোর মধ্যে প্রস্তাবিত গবেষণা প্রশ্নের মিমাংসা উপস্থাপন করতে হবে। প্রবন্ধটির যেসব দূর্বলতা আমি উল্লেখ করেছি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেকেই আছে বাংলাদেশে যারা এগুলো উল্লেখ করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে কি এমন কখনো দেখা যায়? না, খ্যাতিমান অধ্যাপকের লেখা এভাবে নির্মোহ পর্যালোচনা করার চর্চা বাংলাদেশ দূর্লভ। বাস্তবে, কোনপ্রকার পর্যালোচনা/সমালোচনাই করা সম্ভব নয়। কারণ, অনিবার্যভাবেই পর্যালোচনাকারীকে আক্রমণ করা হয় এই অভিযোগে যে তিনি অধ্যাপকের কুৎসা/সম্মানহানি করছেন। অথচ, যেকোন একাডেমিক প্রবন্ধ নানান পর্যায়ে কঠোর পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য মানের বিচারে উৎরে গেলেই কেবল প্রকাশিত হয়। আমার বিবেচনায়, আলোচ্য প্রবন্ধটি সম্পাদনায় মানের বিচার মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে বলেই এটি প্রকাশিত হয়েছে। এমন প্রকাশনা গবেষক হিসেবে খ্যাতি নিয়ে আসার বদলে আগে যেটুকু ছিল তা-ও ধূলায় মিশিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের স্বাধীনতারও আগে। অথচ, এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো সমাজবিজ্ঞানী ক’জন আছেন আর তাদের গবেষণা অবদানই বা কতটুকু? এইখানে আলোচ্য অধ্যাপক কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন ১৯৮০-র মাঝামাঝি। তারপর দেশে ফিরে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় আছেন অদ্যাবধি। বিগত চার দশকে তার না আছে কোন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশনা, না-আছে সমাজগবেষণার কোন বিশেষ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অবদান। অথচ, তার যোগ্যতা এবং দক্ষতার কোন অভাব ছিলনা। তাহলে তিনি কেন একাডেমিক হিসেবে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পথ প্রদর্শনের পথে গেলেন না? একই রকম হতাশামূলক প্রশ্ন করা যায় তার পরের প্রজন্মের অধ্যাপকদের অনেককে নিয়েই, যারা বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে এসেও একাডেমিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রাখছেন না।
অনেকে বলেন যে, গবেষণা ফান্ডের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়না। একথার সত্যটা স্বীকার করেও আমি মনে করি যে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণার জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনার অভাবই মূলতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা না-হওয়ার সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল সব দেশে যেখানে অধ্যাপনার পদে নিয়োগ, প্রমোশন, বোনাস ইত্যাদি নির্ধারিত হয় একাডেমিক পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে, সেখানে আমাদের দেশে হয় একাডেমিক এইসবের বাইরের বিবেচনায়। উদাহরণস্বরূপ, দীর্ঘ চারদশক অধ্যাপনার পদে থেকেও কোন প্রকার মৌলিক গবেষণা বা মানসম্মত জার্নালে প্রকাশনা না-করেও আলোচ্য প্রবন্ধের লেখক সমাজবিজ্ঞানে সারা দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় একজন হতে পেরেছেন। নিত্যনতুন পড়াশোনা বা গবেষণা না-করেই যদি এমন খ্যাতি অর্জন করা যায়, তাহলে কে কষ্ট করবে? গবেষণা না-করার জন্য প্রমোশন আটকে থাকেনা, চাকুরী যাওয়া আরও দূরের কথা। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মূল ভিত্তিই গবেষণা এবং প্রকশনা।
কাজেই, বাংলাদেশের সমাজ গবেষণাকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে এগিয়ে নিতে হলে পড়াশোনা ও গবেষণাকে বিশ্বমানে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালোচনার সংস্কৃতি প্রচলনের কোন বিকল্প নাই। সেই সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণাকে সবকিছুর ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষার উন্নতি চাইলে, জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে চাইলে অধ্যাপনাকে পেশাগতভাবে নিতে হবে।
Comments