আধূনিকতাকে মোটাদাগে আমরা প্রথাগত ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়ী থেকে ব্যক্তির মুক্তি হিসেবে জানি। আধুনিকতার সূতিকাগার ইউরোপের ইতিহাস আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয়। আধুনিক ইতিহাস প্রথা, সংস্কার, ধর্ম, ঈশ্বর, দেবদেবীকে হঠিয়ে দিয়ে ব্যক্তিকে ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ব্যক্তির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা, ব্যক্তির বিকাশ, ব্যক্তির ক্ষমতা ও অবদানের স্বীকৃতি হয়ে ওঠে চর্চার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। এই ব্যক্তি প্রমিথিউস, যে তার ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়ে অসীম ক্ষমতাধর দেবতা জিউসের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী এই ব্যক্তিই পরাভূত করেছিল শতাব্দীব্যাপি জগদ্দল পাথরের মত চেপে থাকা যাবতীয় প্রথা, সংস্কার আর পশ্চাৎপদতা। এই বিপ্লব ছিল সামন্ত আর ধর্মীয় নের্তৃত্বের বিরুদ্ধে, যারা সমাজের উপর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে একত্রে ব্যক্তিকে দাবায়া রাখত, ব্যক্তির সমস্ত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করত নিজেদের কায়েমী স্বার্থে।
ইউরোপীয়দের উপনিবেশ হওয়ার পূর্বে বাংলায় ইতিহাসও ছিল নানান কল্পকথা, দেবদেবী ও অতিমানব-মানবীর কাহিনীতে ভরপুর। ইংরেজদের শাসনের সাথে সাথে এইখানেও ইতিহাস চর্চায় পরিবর্তন আসে। শুরু হয় আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা এবং সেই সাথে আধুনিক ইতিহাস চর্চা যা এখনও সদর্পে চলছে। আফটারঅল, আধুনিকতাকে কে না চায়? কিন্তু রণজিৎ গুহের মতে, বাংলায় এই যে ইতিহাস চর্চা ধারা, এর গোড়াতে একটা গলদ আছে। এটা আমাদের ইতিহাস চর্চা এবং একইসাথে ইতিহাসবোধের উপর একটা ঠুলি পড়িয়ে দেয়। এরফলে আমরা ইতিহাসের একটা খণ্ডিত অংশমাত্র নিয়েই নাড়াচাড়া করি। প্রকৃত ইতিহাসের অনেকাংশ থেকে চোখের আড়ালে, মনেরও। এই গলদটা কি?
বৃটিশ-ভারতে জন্ম নেওয়া ইতিহাসচর্চার প্রথম বৈশিষ্ট্য হল - ইতিহাস লেখক সকলেই ছিলেন সরকারি কর্মচারী, সরকারের প্রসাদপুষ্ট এবং বৃটিশ শাসনের সমর্থক সরকারি ও বেসরকারি সাহেব আর মেমসাহেব। অতএব, এদের হাতে রচিত ইতিহাস তাই স্বভাবতই ইংরেজদের গুণকীর্তনে ভরা। কর্তার নুন খেয়ে গুণত গাইতেই হয়।
দ্বিতীয়ত বৈশিষ্ট্য ছিল সমাজের উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাত। ইংরেজ শাসনের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল অধিকৃত বাংলায় রাজস্ব আদায়। আর এই করতে গিয়ে তারা এদেশীয়দের মধ্য থেকে “ন্যাচারাল লিডার্স বা স্বভাবনেতা”দের খুঁজে নিয়ে তাদের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহকে নিশ্চিত করতে প্রয়াস পায়। ফলে প্রথম দিককার সরকারি কাজগপত্রে এদের সাথে জমির সীমানা ও রাজস্ব ভাগাভাগির আলাপ, আইনগত নানান দিক, ইত্যাদিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। আর এইসব দলিলের ভিত্তিতে যে ইতিহাসের চর্চা, তার মধ্যে সেইসব ভূস্বামী, সামন্ত ও সমাজনেতার মালিকানা ও ক্ষমতার স্বীকৃতি থাকাটাই ত স্বাভাবিক; সেটা আছেও সিংহভাগ জুড়েই।
অর্থ্যাৎ, জন্মের সময়কার বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতার জন্যই বাংলায় আধূনিক ইতিহাসের চর্চা উল্লিখিত দুইটা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এটি আগেকার প্রচলিত কল্পকথা, নীতিকথা আর ধর্মকথাকে হটিয়ে দিয়ে আধুনিক ইউরোপের অনুসরণে ব্যক্তি মানুষ ও তাদের দৈনন্দিন সামাজিকতাকে ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রে এসেছে ঠিকই। কিন্তু উপনিবেশ বাংলার ইতিহাসের এই ব্যক্তি ইউরোপীয় রেনেসাঁর ব্যক্তির থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। বাংলার এই ব্যক্তি ইউরোপের স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি নয়। বরং বাঙালি এই ব্যক্তি বরং বিদেশী শাসনের দোসর, বিদেশী প্রশাসনের আশ্রয়ে দেশীয় জনতার উপর চেপে বসা সামন্তপ্রভূ, জমিদার, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষিত বাঙালি বাবু।
অর্থ্যাৎ, ইউরোপের ব্যক্তি যেখানে আধুনিকতাকে ধারণ করে ভূমির-মালিকানা ও চার্চের (তথা, ধর্মীয়) নের্তৃত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রগতির পথে চলা শুরু করেছে, বাংলায় এসে সেই আধুনিকতা যাত্রা শুরু করেছে ভূমির নতুন মালিক ইংরেজ প্রশাসনের স্থানীয় দোসরদের হাত ধরে। এজন্যই আধুনিকতা ইউরোপে ব্যক্তির স্বাধীনতার ধারক ও বাহক হলেও বাংলায় এসে সেই ব্যক্তি-স্বাধীনতার অন্তরায় শক্তির হাতে পড়েছে। বাংলার তথাকথিত রেনেসাঁকে এজন্যই আমরা দেখি কতিপয় যুগ-পুরুষের অবদান হিসেবে, ফরাসী বিপ্লবের মতো কোন গণঅভ্যুত্থান হিসেবে নয়। তাই আমাদের ইতিহাস বইয়ের সিংহভাগ জুড়ে থাকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অবদানের বিস্তারিত আলোচনা। আর গণমানুষের অভ্যুত্থানগুলো হয় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আর নাহয় ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, চাষাভুষাদের ফরায়েজী আন্দোলন, অশিক্ষিত মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলন, ইত্যাদি নামে বইয়ের শেষ অধ্যায়ের কোনা-কাঞ্চিতে।
Comments