ছবিঃ প্রথম আলো, ৩০শে আগস্ট, ২০১৯।
১
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় শাড়ি নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। লিখেছেন বিশ্বাসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক, আলোকিত মানুষ তৈরির কারিগর হিসেবে বরেণ্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তার চিরাচরিত ঝরঝরে, সুখপাঠ্য গদ্য আর নানান নান্দনিক বিশেষণ সম্ভারে চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায় তিনি শাড়িকে প্রথমে চিত্রিত করেছেন “পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, "রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক” হিসেবে। এরপর শাড়িকে বাঙালি নারীর “প্রকৃতিগত পোশাক—তাদের সহজাত রূপের অংশ” হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি নারীকেও একই মহিমায় উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। অন্তত তার গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী এবং সাহিত্যানুরাগীরা এভাবেই প্রবন্ধটি পাঠ করতে চান। কিন্তু যে কারণে আবু সায়িদ শাড়িকে বাঙালি নারীর প্রকৃতিগত ও সহজাত পোশাক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা নির্জলা বর্ণবাদী। স্বভাবতঃই লেখাটি বিতর্কিত হয়েছে, লেখক হিসেবে আবু সাইয়িদের আলোকিত মানুষ পরিচয়ের সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি তার গুণমুগ্ধ ছাত্রীদের কেউ কেউ তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, “স্যার ওভাবে না-বললেও পারতেন”। আমি বলি, না, তিনি পারতেন না। কারণ, তিনি বাঙালি নারীকে দেখেন প্রকৃতিগতভাবেই অসুন্দর বলে যারা বেঁটেখাটো, যাদের দেহসৌষ্ঠব অবিন্যস্ত। তাই তিনি উল্লেখ করেছেন “শারীরিক অসমতার এত ঘাটতি থাকার পরও অন্যান্য মেকআপের মতো রূপকে নিটোলতা দেওয়ার মতো এক অনন্য সাধারণ মেকআপ রয়েছে বাঙালি মেয়েদের ভাঁড়ারে। আমার মতে, এর নাম ‘শাড়ি’।”- আপাতঃ দৃষ্টিতে এই বয়ানকে নিরীহ, এমনকি ক্ষণিকের জন্য প্রশংসাসূচক মনে হলেও তা আদতে বাঙালি নারীর প্রতি চরম অবজ্ঞামূলক। আর যে মন, যে জ্ঞান, যে উপলব্ধি থেকে এই বাক্য উৎসারিত হয়েছে, তা বর্ণবাদী।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বর্ণবাদের উদাহরণ খুঁজলে সবার আগে আসবে রোহিঙ্গা শরণার্থিদের প্রতি আমাদের অনেকের আচরণ ও কথাবার্তা। বর্ণবাদ শব্দটির সাথে পরিচিত সকলেই একমত হবেন যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে জাতিগতভাবেই নিচু-সংস্কৃতির মানুষ বলে মনে করাটা বর্ণবাদী। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সন্ত্রাসী, পঙ্গপালের মতো বাচ্চা জন্মদিয়ে আমাদের দেশ একসময় দখল করে নিবে, আমাদের উপরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোঝা হিসেবে চেপে বসবে, ইত্যকার নানান কথাবার্তা এখন বেশিরভাগ পত্রিকাতেই দেখা যায়। জনপরিসরে আলাপচারিতায়ও এইসব নিতে মাতামাতি হচ্ছে। এইসব যে খারাপ, তা সকলেই বোঝে- যারা বলে এবং যারা শোনে উভয়েই জানে যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এইসব কথা নিন্দনীয়। কারণ, এইগুলো বর্নবাদী কথাবার্তা। আর যারা এগুলো বলে, তারা রেসিস্ট। তাদের জন্য আমাদের কাছে নিন্দা ছাড়া আর কোন বিশেষণ নেই। তবে এই ধরণের প্রকাশ্য বর্ণবাদের থেকেও বেশি বিপদজনক হলো সাহিত্যে, সমাজকর্মে, রাজনীতিতে জাতীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের মধ্যে লুক্কায়িত বর্ণবাদ, যা সচরাচর চিহ্নিত করা যায়না। এরফলে সেইসব ব্যক্তিত্বের কথা, কাজ ও নীতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে তাদের হাজার হাজার গুণমুগ্ধ অনুসারীরাও অজান্তেই বর্ণবাদী ধারণা আত্মস্ত করে। তাই, আমি মনে করি বর্ণবাদ কি, কোথা হতে এর উৎপত্তি আর কেন একে এড়িয়ে চলা উচিত, ব্যক্তিমানস, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কিভাবে এটি দূর করা সম্ভব এইসব বিষয় নিয়ে আলাপ করা জরুরী।
২
বর্ণবাদ শব্দটির সাথে আমার পথম পরিচয় হয় প্রায় পঁচিশ বছর আগে ইংরেজী পাঠ্য বইয়ে আংকেল টমস কেবিন নামের একটা ছোট্ট গল্পের মধ্য দিয়ে। জেনেছিলাম আমেরিকায় কালোমানুষদেরকে গরুমহিষের মতো কেনাবেচা করা হয়, খেতেখামারে পশুর মতো খাটানো হয়, গোয়ালঘরের থেকেও খারাপ কঠুরিতে রাখা হয়। মনিবের চাহিদামত সর্বোচ্চ শারীরিক পরিশ্রম করতে না-পারলে পশুর মতো পিটানোসহ আরও যতপ্রকার শারীরিক শাস্তি কল্পনা করা সম্ভব যেসবই প্রয়োগ করা হয়। সেসময় বই পড়ে এইসব কল্পনা করতাম আর আমেরিকার দাসপ্রথার মধ্যে শৃংখলিত কালোমানুষদের জন্য দঃখবোধ করতাম। এখন সিনেমাতেও দেখা যায় আফ্রিকা থেকে ধরে নিয়ে আসা কালোমানুষদের উপর দাসমালিক সাদামানুষদের সেইসব অত্যাচারের কাহিনী, যা’ বিবেকবান যেকাউকে নাড়া দিবে।
আধুনিক সমাজের বর্ণবাদ জন্মলাভ করেছে ইউরোপীয়দের সাদামানুষদের হাতে বন্দি আফ্রিকার কালোমানুষদের দাস হিসেবে আমেরিকায় স্থানান্তর ও তাদেরকে দিয়ে পশুর মত হালচাষ করানোর ব্যবস্থার মধ্যে। আর সেইসব কালোমানুষদেরকে পশুজ্ঞান করে তাদের প্রতি সেইমত ব্যবহার করার রীতিনীতিকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে স্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন আইনে, লোকাচারে, বিশ্বাসে। দুইশ বছর একাদিক্রমে ক্ষেতেখামারে পশুর মত খাটতে খাটতে, সাদা দাসমালিকদের কাছ থেকে পশুরন্যায় ব্যবহার পেতে পেতে এইসব কালো মানুষ ভুলে গিয়েছিল তাদের মাতৃভাষা, আবার ইংরেজিকেও আয়ত্ব করার সুযোগ পায়নি। এরা ভুলে গিয়েছিল সভ্য-সাধারণ মানুষের মতো জীবনাচরণ। এ-ই থেকে ক্রমশঃ সাদা মানুষেরা, দাসমালিকেরা এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছে যে, কালোমানুষেরা মানুষ পদবাচ্যই নয়। এরা বড়জোর ঊনমানুষ। অতএব, তাদের প্রতি যাবতীয় পাশবিক ব্যবহার করা যথার্থ।
সমাজে একটা দল বা গোষ্ঠীর সমস্ত মানুষকে তাদের গায়ের রঙের পার্থক্যের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখার এই যে রীতি, এটা আমেরিকার অধিকাংশ সাদামানুষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু কালোমানুষও স্বাভাবিক হিসেবে আত্মস্থ করে নেয়। ফলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করার পরেও সেখানে গায়ের রঙের ভিত্তিতে সামাজিক বিভাজন এবং উঁচুনিচু ভেদাভেদ চলেছে আরও একশ বছর, বিবিধ সামাজিক রীতিনীতি আর আইনকানুনের মধ্য দিয়ে সামাজিক প্রথা হিসেবে। মাত্র সত্তরের দশকে সিভিল রাইটস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমেরিকার বর্ণভেদকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে কালো-আমেরিকানদেরকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। সিভিল রাইটস আন্দোনলের ভিত্তিমূলে যেসব মূল্যবোধ- যথা, সার্বজনীন সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য- তা’ কালো-আমেরিকানদের প্রতি সাদাদের আচরণকে অমানবিক, অতএব অগ্রহণযোগ্য এবং অন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গায়ের রং - অর্থ্যাৎ জন্মগত- বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমাজে একেকটা জাতি, দল বা গোষ্ঠী হিসেবে আলাদা করে শ্রেণীবিন্যস্ত করা, অতঃপর সেইসব শ্রেণীকে ভালো-মন্দ, উঁচুনিচু, ইত্যাদির মাপকাঠিতে বিবেচনা করার যে রীতি বা প্রবণতা দেখি, তাকেই নৃবিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় বর্ণবাদ। এর শুরু হয় নিরীহদর্শন পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যাবলী চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। মানুষ হিসেবে আমরা স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুকে ক্লাসিফাই বা শ্রেণীবিন্যস্ত করি হিসেব রাখার সুবিধার্থে, বোঝার সুবিধার্থে। যেমন, চালের বাজারে গেলে চালের রং, আকৃতি, সুবাস, স্বাদ, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমরা চালের শ্রেণিবিভাগ করি, আলাদা আলাদা চালের চাহিদা ও যোগান অনুযায়ী ভালোমন্দের বিবেচনা আরোপ করি। একইভাবে আর প্রায় সব পণ্য, বস্তু, স্থান, ইত্যাদির মধ্যে এদের নিজ নিজ প্রাকৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভালোমন্দের শ্রেণীবিভাজন করি, এবং সেইমত তাদের প্রতি আমাদের আচার-ব্যবহারও হয় আলাদা আলাদা। যেমন, সবথেকে ভালো বস্তুটি পেতে আমরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করি, আর খারাপটির দিকে ফিরেও তাকাইনা।
মানুষের মাঝেও আমরা নানান রকম বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করি। তাদেরকে পৃথক পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত করি। ভালো মন্দের ভিত্তিতে উঁচুনিচু ভেদাভেদও আরোপ করি। বাস্তবিক প্রয়োজনেই। যেমন, ইন্টারভিউ করে সবথেকে যোগ্য প্রার্থীকে চাকুরীর জন্য বাছাই করি। কিন্তু এইভাবে পার্থক্য করা আর উপরে উল্লিখিত পণ্য, বস্তু, বা প্রাণিজগতে পার্থক্য আরোপ করা মৌলিকভাবে আলাদা। চালের যে বৈশিষ্ট্য তা’ প্রাকৃতিক, অশ্বের যে শক্তি তা প্রাকৃতিক, গোলাপের যে সৌন্দর্য তাও। এইসব গুণ বা ত্রুটিবাচক বৈশিষ্ট্যে এদের কোন হাত নাই। ফলে বিশেষ কোন শ্রেণীর যাবতীয় চাল একই বৈশিস্ট্যমন্ডিত। ভালো হলে ভালো, মন্দ হলে মন্দ। কিন্তু মানুষকে বিবেচনা করার বেলায় আমরা পরিচালিত হই একটা সার্বজনীন মূল্যবোধ দ্বারা। এইটি হল- জগতের সকল মানুষ সমান, জন্মগতভাবে সামর্থের বিচারে পার্থক্য থাকা সত্বেও। এইথেকে আমরা আরও একটি মূল্যবোধ ধারণ করি যে, মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদা করি তা মূলতঃ ব্যক্তির নিজ নিজ কর্মের ফল। যেমন, কেউ পরীক্ষায় প্রথম হলে, কিংবা পেশাগত ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করলে আমরা পুরস্কৃত করি। কিন্তু কেউ ব্যর্থ হলে আমরা তাকে তিরস্কার করিনা, কেবলমাত্র নির্ধারিত পুরস্কার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় এবং পরবর্তীতে আবার প্রতিযোগিতায় আসার জন্য উৎসাহিত করা হয়। সাফল্য প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি ব্যক্তির সাথে সাথে তার পরিবার, আত্মীয়-প্রতিবেশী-দেশকেও সম্মানিত বা সম্মান থেকে বঞ্চিত করলেও আমরা সবাই বুঝি যে আসল প্রাপ্তিটা/অপ্রাপ্তিটা ব্যক্তির। আমরা বিশ্বাস করি যে, সবক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার মর্যাদা অর্জন করে বা হারায়। আর সেইসব প্রতিযোগিতায় সকল ব্যক্তির অংশ গ্রহণ করার অধিকার সমান। যখন আমরা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হওয়ার আগেই কাউকে অযোগ্য বলে বাতিল করে দেই, সেটাকে বলি অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য। আর ব্যক্তিবিশেষের অযোগ্যতাকে যখন আমরা অনুমান করি তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য এবং তার গোত্রের সকলকেও একই রকম হিসেবে দেখি, সেটাই বর্ণবাদ। যেমন, আফ্রিকার সমগ্র কালোমানুষদের কিছু অংশকে দাস হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে দুশ বছর ধরে চরম অত্যাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট করে তাদের সকলকে অশিক্ষিত, অনগ্রসর জীবনযাপনের মধ্যে ঠেলে দিয়ে এখন সমগ্র আফ্রিকার কালো মানুষদেরকেই বর্বর বলে গণ্য করাটা হচ্ছে বর্ণবাদ। একইভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে বংশ পরম্পরায় জাতপ্রথার নিষ্পেষণে রেখে নিচুজাত বলে পরিচিতিদের মধ্যে অশিক্ষা, অনগ্রসরতা দেখে এগুলোকে তাদেরকে জন্মগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করাও বর্ণবাদ।
বর্ণবাদের সূচনা হয় নিরীহ একটা প্রবণতা থেকে যাকে সমাজবিজ্ঞানে বলা হয় stereotype। এর অর্থ হল- গুটিকয় ব্যক্তির মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষ্য করে সেটাকে তাদের সমগোত্রীয় সকলের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিশ্বাস করা। যেমন, আমেরিকার সিলিকন ভ্যালীতে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের আধিক্য দেখে এই বিশ্বাসে উপনীত হওয়া যে, ভারতীয়রা জন্মগতভাবেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উপযুক্ত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। আবার একই অঞ্চলে মেক্সিকানদেরকে গায়েগতরে খাটার পেশায় অধিক হারে দেখে এই বিশ্বাস করা যে, মেক্সিকানদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য উপযুক্ত মেধার অভাব বিদ্যমান। stereotype এর পরের ধাপটিই বর্ণবাদের সূচনা, যেখানে এইসব প্রচলিত stereotype-ভিত্তিক বিশ্বাসের মাপকাঠিতে আমরা সমাজের নানান দলের মধ্যে, জাতির মধ্যে উঁচুনিচু ভেদাভেদ করি। অধিকাংশ বাঙালি নারীদেরকে বেঁটেখাটো দেখতে পেয়ে তাদেরকে বেঁটেখাটো বলে একটা stereotype বা বিশ্বাস জন্মায় যা কমবেশি আমাদের সকলের মধ্যেই আছে। এইটা বাস্তব, এইখানে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এইখান থেকে যদি অন্যান্য জাতির নারীদের সাথে তুলনা করে বাঙালি নারীকে অসুন্দর, অনাকর্ষণীয়, অগ্রহণযোগ্য বলি, সেইটা বর্ণবাদ। বাঙালি নারী অন্যান্য জাতির নারীদের তুলনায় নিজেদের সৌন্দর্যের ‘ঘাটতি’টি ঢেকে রাখার পোশাক হিসেবে শাড়ি পবে বলে অনুমান করাও বর্ণবাদী।
৩
stereotype আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে আমরা যখন সমাজে উঁচুনিচু ভেদাভেদ করি এবং তদনুযায়ী কাউকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই আবার কাউকে বিতাড়িত করি, সেটা অন্যায়। সমাজবিজ্ঞানে এর নাম discrimination বা বৈষম্য। মানুষ সবর্দাই এই বৈষম্যকে দূর করতে সচেষ্ট হয়েছে। সকল যুগে দার্শনিক, নবী-রসুল ও ধর্মীয় নের্তৃত্ব, সমাজসংস্কারক সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সংগ্রামে নের্তৃত্ব দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টিকারী যাবতীয় বিষয় অমানবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্ণবাদও একইভাবে আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের নানান প্রান্তে সংগ্রামী মানুষের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে।
বর্ণবাদ ঘৃণ্য হওয়া সত্বেও সব সমাজেই নানা মাত্রায় এটি বিদ্যমান, সামাজিক পরিমণ্ডলে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, সর্বত্র। কিন্তু সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ তথা ‘সকল মানুষ সমান’ এই বিশ্বাসের জন্য সর্বত্র বর্ণবাদকে উচ্ছেদ করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়; কোথাও আইনের মাধ্যমে, আবার কোথাও নানা প্রকাশ সামাজিক বিধিনিষেধের মাধ্যমে। প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক পর্যায়ে বর্ণবাদ অনেক স্পষ্ট, যেমন মিডিয়াতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে যেসকল অপপ্রচারগুলো করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই সেইসব নেগেটিভ সংবাদগুলোকে ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক বলে চিহ্নিত করেছেন। একইভাবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় বিভাগ মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও তাদেরকে বিভাগে ভর্তি না-করাও ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ এবং সচেতন অনেকেই সেটাকে নিন্দা করেছে। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে আমরা নিজ নিজ ভাবনা-চিন্তাগুলো সংগোপনে লালন করতে পারি, সরাসরি কথায় বা কাজে প্রকাশ না করেও। আর এমন বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণা লালনকারী কেউ যখন সমাজের মাথায় বসে, কথায় ও কাজে-কর্মে অনেক সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা অর্জন করে, সেটা হয় পুরো সমাজের জন্যই ক্ষতিকর। যেমন, শাড়ি নিয়ে অধ্যাপক আবু সায়ীদের লেখা পত্রিকার কলামটি। এটি বাঙালি নারী ও পুরুষ সকলের মধ্যে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে যে, বাঙালি নারী জন্মগত ভাবেই অসুন্দর। অতএব, তারা জ্ঞানবিজ্ঞানে, রাজনীতিতে, সাহিত্যে, কি খেলাধুলায় যতই পারদর্শী হোক না কেন, যতটা উচ্চতায়ই নিয়ে যাকনা কেন, তাদের জন্মগত একটা ঘাটতি থাকবেই- তারা বেঁটেখাটো এবং সেইজন্য অসুন্দর। অতএব, যাবতীয় সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি তাদেরকে শাড়ি দিয়ে সেই অসুন্দর শরীর পুরুষের জন্য “শালীন” এবং একইসাথে “যৌনাবেদনময়ী” করে সাজাতে হবে। এই বয়ানে বর্ণবাদ এতোটাই প্রকট যে, প্রকাশের সাথে সাথেই এই লেখা প্রশ্নের মুখে পড়েছে, লেখক আবু সায়ীদের সমালোচনা শুরু হয়েছে। তিনি সবথেকে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছেন এই জন্য যে, দীর্ঘদিন ধরে তিনি বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে বই পড়ার মাধ্যমে আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমরা সকলেই কি অনুরূপ বর্ণবাদের উর্ধ্বে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দক্ষিণের কয়েকটা জেলার বন্ধুদেরকে বিএনসিসি বলে মজা করতাম তারা স্বার্থপর বলে। সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে শুনি এটা মেয়েদের সাবজেক্ট, নাম লিপিস্টিক ডিপার্টমেন্ট। সবসময় দেখেছি ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এই নিয়ে নানান আড্ডায় হাস্যরসের শিকার হয়েছি। কিন্তু এইসব থেকে দেখেছি কেউ কেউ দক্ষিনের জেলাগুলোর লোকজনকে সত্যি সত্যি স্বার্থপর বলে মনে করে, সমাজবিজ্ঞানের ছেলেদের মধ্যে ম্যানলি-ভাবের অভাব আছে মনে করে। একইভাবে, মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে অনেকে আনস্মার্ট অথবা মৌলবাদী মনে করে। এইসব stereotype ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকেই। কিন্তু যখন এমন ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন কোন ব্যক্তি নীতিনির্ধারণী পদে, ক্ষমতাসীন পদে যায়, তখন সেটা তার প্রভাবাধীন বলয়ে বর্ণবাদের জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি করে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমার এক রুমমেট চারবার বিসিএস এর ভাইভা বোর্ডে গিয়েও একটা সরকারী চাকুরী পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তার বিশ্বাস, সে মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছিল বলে তাকে সরকারী চাকুরী থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার অধ্যাবসায় এবং মেধার সাথে পরিচয় ছিল বলে আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি। তার অনুমান আরও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে এইজন্য যে, বিসিএসের ভাইভাবোর্ডে বসতেন এমন কয়েকজন অধ্যাপককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম যারা মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতি এইরূপ ধারণা পোষণ করতেন। আমাদের সময় একজন সম্মানিত অধ্যাপক তার ক্লাসে কোন ছাত্র-ছাত্রী অনুমোদনব্যতীত কথা বললে তিনি বকা দিতেন এই বলে যে, “অসভ্য, বর্বর, আফ্রিকার জঙ্গল থেকে এসেছে।” তাকে পুরো ছাত্রজীবনে দেখেছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি তিনি বর্ণবাদী নন। অথচ, কি অবলীলায় তিনি একটা বর্ণবাদী কথা বলতেন আফ্রিকানদের নিয়ে, যা’ অবচেতনেই ছাত্র-ছাত্রীদের মনে থেকে যেতো। সমাজের একটা বড় অংশের মানুষকে প্রভাবিত করার মত উচ্চ অবস্থানে থেকে স্বীয় বিশ্বাসে ও ধ্যান-ধারণায় বর্ণবাদ লালনকারী ব্যক্তি তার প্রভাবাধীনদের মধ্যেও কখনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে আবার কখনো অবচেতনে বর্ণবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন, যা বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এবং যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। যেমন, বর্তমানে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বর্ণবাদ আরও অসংখ্য মানুষের বর্ণবাদী আচরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে আইনকানুন আরোপের মধ্য দিয়ে বর্ণবাদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করছে।
নিজেদের ভাবনাচিন্তায় বর্ণবাদ রেখে যেমন অন্যকাউকে সমালোচনা করার কোন নৈতিক অধিকার থাকেনা, তেমনি সেই সমালোচনা থেকে ভালো কোন ফলও আশা করা যায়না। এজন্য দরকার অন্যদের মধ্যে বর্ণবাদের সমালোচনার পাশাপাশী নিজের দিকে ফিরে দেখা, নিজস্ব বিশ্বাসে ও চিন্তা-চেতনায় বর্ণবাদ আছে কিনা তার তত্ত্ব-তালাশ করা এবং আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা। এরজন্য খুব বেশি প্রয়াসের দরকার হয়না। সামান্য চেষ্টা করে বর্ণবাদের লক্ষ্যে থাকা মানুষদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি সামান্য বাড়ালেই এই থেকে নিজেদের বিশ্বাসকে মুক্ত করা সম্ভব। যেমন, খুব কাছথেকে মেলামেশা করার মধ্যদিয়ে জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মধ্যে সবথেকে পরোপকারী বন্ধুটির বাড়ি বরিশাল, আমার পরিচিত অন্যতম মেধাবী মাদ্রাসা-ব্যাকগ্রাউন্ডের যে বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে এখন দেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও গবেষক। একইভাবে, পরিবারে এবং আশেপাশের নারীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা সম্ভব কেন তারা শাড়ি পরে এবং কেনই বা অনেকে নারী বর্তমানে শাড়ি বাদ দিয়ে অন্যান্য পোশাকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বর্ণবাদী ভাবধারা ধারণ না-করেও অনেক সময় আমরা অনেকেই বর্ণবাদী আচরণ করে থাকি আমার উল্লিখিত সেই অধ্যাপকের মতো, অথবা সেইসব লোকেদের মতো যারা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করছে। কথায়-বার্তায় আকেরটু সতর্ক হলে, বর্ণবাদের শিকার জনগোষ্ঠীর বিষয়ে জানতে আরেকটু আগ্রহী হলেই বর্ণহীন, সুপ্ত এই বর্ণবাদ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা যায়।
বর্ণবাদের সম্পর্কে যথাযথ আলোচনা এবং বিশ্লেষণ হওয়ার দরকার আমাদের প্রাত্যহিক এবং সামাজিক পরিসরে। তবেই আমরা বর্ণবাদমুক্ত একটা সমাজ পেতে পারি।
নোটঃ লেখাটি দৈনিক বণিকবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ২৮ অক্টোবর, ২০১৯।
Comments