top of page
  • Hasan Mahmud

সমকামী যৌনাচারের সমাজতত্ত্বঃ প্রেক্ষিত আয়মান সাদিকের প্রতি হত্যার হুমকি এবং পরিচয়ের রাজনীতি

Updated: Jul 19, 2020





নোটঃ ছবিটির কপিরাইট Ann Telnaes-এর।


আয়মান সাদিককে হত্যার হুমকির তদন্তে পুলিশ শিরোনামে একটা খবর গত ৬ জুলাই বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সফল অনলাইন পাঠদান কর্মসূচীর উদ্যোক্তা এবং ‘টেন মিনিট’ নামক অনলাইন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আয়মান সাদিককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে আয়মান সাদিক জানান যে, "আমাকে বলা হচ্ছে আমি নব্য মিশনারি, আমি কাফিরদের এজেন্ট, আমি পশ্চিমা অপসংস্কৃতি প্রচার করার এজেন্ট”, এবং “এই মুরতাদকে যেখানেই আপনারা পাবেন, তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিবেন এবং শত শত না হাজার হাজার মানুষ সেটা শেয়ার করছে”। স্বভাবতঃই সাদিক, তার পরবার-পরিজন এবং শুভানুধ্যায়ীরা আতঙ্কিত হয়েছেন। সাদিক বুঝতে পেরেছেন যে, এই হুমকিটা আসছে উগ্র ইসলামিস্টদের কাছ থেকে। এর কারণ নির্ণয় এবং প্রতিকারও তিনি করেছেন এইভাবেঃ “ঋতুস্রাব ও সম্মতি নিয়ে করা ওই দুইটি ভিডিও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণে তারা দুঃখিত এবং ক্ষমা-প্রার্থী।”


ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া এবং ফলশ্রুতিতে গণ-অসন্তোষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা থেকে সহিংস আক্রমণ ও হত্যার মতো অপরাধমূলক ঘটনা আমাদের অজানা নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ত বটেই, আমাদের বাংলাদেশেও এমনটি ঘটার নজির আছে। যেমন, নাস্তিক ব্লগারদের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ, যার মধ্যে ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ হত্যা বহুল আলোচিত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং তার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত বিতর্কে দুইটা প্রধান ধারা লক্ষ্যনীয় - প্রথমে কোন বক্তব্য প্রকাশ করা হয় যা’ ধর্মীয় কোন বিশ্বাস বা আইকনকে হেয় করে। এরপর ধর্মপ্রাণ জনসাধারণ হেয়কারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। এই সুযোগে উগ্রবাদী কোন গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সন্ত্রাসী আক্রমণের হুমকি প্রচার করে এবং কখনো কখনো সহিংস আক্রমণ পরিচালনা করে। সাদিকের বক্তব্যেও এই প্যাটার্ণ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।


এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক গণমাধ্যমে চলমান বিতর্কের মধ্যে দুটো বিষয় আমার মনোযোগ আকর্ষন করেছেঃ এক, সাদিককে হত্যার হুমকি প্রদানকারী নিঃসন্দেহে সন্ত্রাসী এবং অপরাধী। কিন্তু উল্লিখিত ভিডিওগুলোর সমালোচনা করছে এমন সকল ব্যক্তিকেই উগ্রবাদী সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসের সমর্থক বলে প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে নিন্দা করা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ, বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান জঙ্গি অথবা জঙ্গি মনোভাবাপন্ন। দুই, সাদিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার পক্ষে, অনলাইন শিক্ষাদানে অবদান তার অবদান এবং আরও নানা রকম বিবেচনা থেকে যারাই তাকে হত্যার হুমকিদানকে সমালোচনা করছে, তাদেরকে বলা হচ্ছে ইসলামবিরোধী বা নাস্তিক। অর্থ্যাৎ, ঘটনার সূত্রপাত দুটো ভিডিও দিয়ে নিয়ে শুরু হলেও বিতর্কটা দ্রুতই সমগ্র সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এইটা এজন্য হচ্ছে যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং তার এহেন প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ আমাদের সমাজের অনেক গভীরে। কাজেই, সাদিকের প্রতি হত্যার হুমকি শুধুমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন আইনী বিষয় নয়, আবার একেবারে সাম্প্রতিক কোন বিষয়ও নয়। অতএব, এহেন অপরাধমূলক ঘটনার কারণ চিহ্নিত করা এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আমাদেরকে এই ঘটনাকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে।




ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগের সাথে সাথে সাদিককে “মিশনারি”, “কাফির”, “পশ্চিমা সংস্কৃতির এজেন্ট” বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। এই বিশেষণগুলো নিশ্চয়ই ব্যক্তি সাদিকের সঠিক পরিচয় দেয়না। কিন্তু এগুলো একধরণের সামাজিক পরিচয়ের ধারণা দেয় ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করায় যাদের অতীত ইতিহাস আছে। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মকে যুগপৎভাবে আঘাত করার ইতিহাসের শুরু হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই। বিশেষ করে ইউরোপীয়, খ্রিষ্টান, মিশনারিরা সেসময় বাংলার মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়কেই পশ্চাৎপদ হিসেবে চিহ্নিত করত এবং এর কারণ হিসেবে দুই ধর্মেরই মৌলিক বিশ্বাস এবং পবিত্র আইকনগুলোর ন্যাক্কারজনক কুসমালোচনা করত। এর প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মসংস্কার আন্দোলন, যাকে পরবর্তীতে বেঙ্গল রেনেসাঁর সূচনা বলে অভিহিত করা হয়। ইসলামের বিরুদ্ধে মিশনারিদের সেইসব কুৎসামূলক প্রচারণার রসদের উৎস হিসেবে ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করেছেন ক্রুসেডের প্রেক্ষিতে ইউরোপে ইসলামের বিরুদ্ধে চালানো প্রোপাগান্ডা। আর হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণার রসদ তারা পেয়েছে প্রাক-উপনিবেশিক যুগে ভারতীয় সমাজের ওরিয়েন্টালিস্ট বা পক্ষপাতমূলক আলোচনার-সমালোচনার মধ্য দিয়ে। এখনকার ধর্মবিদ্বেষী এবং নাস্তিক ব্লগার ও লেখকদের ধর্মীয় সমালোচনা অনেকাংশে ইউরোপীয়, বিধর্মী, মিশনারিদের সেইসব কুৎসামূলক প্রচারণার ধারাবাহিকতা বলেই ক্ষুব্ধ বাঙালি মুসলমান ঝটপট আয়মান সাদিককে বিধর্মী মিশনারিদের দলে ফেলে দেয়।


অন্যদিকে, সাদিকের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেই হত্যার হুমকিদাতাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি উল্লিখিত ভিডিও দুটোর মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধী উপাদান খুঁজে পাওয়া যেকাউকেই জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত যা তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্ট ও মন্তব্যের মধ্যে দৃশ্যমান। তারা দ্রুতই এমন একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারে এইজন্য যে, ৯/১১-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের আপামর মুসলিম জনতাকেই সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। সেইসাথে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে আরও কিছু নেতিবাচক সাধারণীকৃত পূর্বধারণা (stereotype), যেমন- মুসলমানরা প্রথাগত, প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চিমের প্রতি সহিংস, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ ধারণে অক্ষম, ইত্যাদি। কাজেই, এই দলের বিতর্কের মধ্যে সাদিকের প্রতি হত্যার হুমকির সমালোচনার সাথে অবশ্যম্ভাবিরূপেই থাকছে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে সমকামী সম্পর্কের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপন। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় - সমকামী সম্পর্ক বিজ্ঞানসম্মত এবং সেইজন্য শিক্ষিত মানুষ একে একটা স্বাভাবিক যৌনাচার হিসেবে মেনে নিবে। যেহেতু মুসলমান সমাজ এটা মেনে নেয়না, অতএব তারা পশ্চাৎপদ, প্রগতিবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী। আর যারা বিজ্ঞান-সমর্থিত সমকামী যৌনাচারকে স্বাভাবিক একটা সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে মেনে নেয়, তারা আধুনিক, প্রগতিশীল, প্রথাগত বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত। অর্থ্যাৎ, আলোচ্য বিতর্কের মধ্যে বিজ্ঞানের রেফারেন্স নিয়ে এসে তারা মুসলমান সমাজের বিজ্ঞানবিমুখতা নির্ণয় করার পাশাপাশি নিজেদের কেও আধুনিক, প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা হিসেবে জাহির করে। ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের বিতর্কের মধ্য দিয়ে এদের প্রগতিশীল ও মুক্তমনার দাবী কিন্তু অন্যকোন অনুভূতির বেলায় ঠিকই প্রথাগত এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের পরিচয় দেয়। যেমন, জাতীয়তাবাদী কোন বিশ্বাস বা আইকনের অবমাননার অভিযোগে এদের আচরণ বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের মতোই।


সমকামী যৌনাচারের (homosexuality) কথিত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আদতে অনুপস্থিত। গত বছর ৩০শে আগস্ট Nature জার্নালে ‘Large-scale GWAS reveals insights into the genetic architecture of same-sex sexual behavior’ শিরোনামে একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর এমআইটি’র যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত Broad Institute-এ কর্মরত জেনেটিক বিজ্ঞানী Andrea Ganna এবং তার দলের করা এই গবেষণা এযাবৎকালে যৌনাচারের জিনগত তথা জৈবিক ভিত্তি নিয়ে করা সর্ববৃহৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণা। পাঁচ লক্ষ মানুষের জেনেটিক গঠন এবং তাদের যৌনাচরণের উপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষের যৌনাচারের মধ্যে চারভাগের একভাগ (২৫%) তাদের জেনেটিক গঠনের সাথে সমকামের সম্পর্ক অনুপস্থিত। অর্থ্যাৎ, সমকামকে মানুষের স্বাভাবিক জৈবিক আচরণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা এবং একে মানবাধিকার বলে দাবির সমর্থনে বৈজ্ঞানিক সত্যতা প্রায় শূন্য। কিন্তু এরমানে এই নয় যে, সমকামীদের মানবাধিকার নেই, বা সমকামীরা মানবাধিকারের আওতার বাইরে। সার্বজনীন মানবাধিকার দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। আর সমকামীরা নিশ্চয়ই মানুষ। কাজেই, তাদের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু কিভাবে?




টেন মিনিট স্কুলের সাথে সংশ্লিষ্ট দুইজনের ফেসবুকে সমকামের সমর্থনে ভিডিও/বক্তব্য এবং উক্তস্কুলের ওয়েবসাইটে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তিকর দুটো ভিডিও প্রচারিত হওয়ার প্রেক্ষিতে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছে, আর এর মধ্যে যে ধার্মিকতা বা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রদর্শনী চলছে, সেখানে থেকে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির ধার্মিকতা বা বিজ্ঞানমনস্কতার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার উপায় নাই। কারণ, এদের অনেকেই অন্য প্রেক্ষিতে ধর্মবিরোধী বা বিজ্ঞানবিরোধী অবস্থান জানান দেয়। এই বিতর্কে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থান নিলেও এদের মধ্যে একটা বিষয় একটা মিল আছে। আর তা হল পরিচয়ের রাজনীতি। তারা নিজ নিজ দলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে সমাজের চোখে ধার্মিক বা বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে নিজ নিজ পরিচয় প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করছে। অর্থ্যাৎ, সমকামী যৌনাচারের পক্ষে/বিপক্ষে চলমান এই বিতর্ক না ধর্মীয়, আর না বিজ্ঞানবিষয়ক। এইটা আদতে পরিচয়ের রাজনীতি। আর এজন্যই অংশগ্রাহনকারীরা প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক বা বিজ্ঞানমনস্ক না-হয়েও, সমকামের বিষয়ে ধর্ম বা বিজ্ঞানের যথেষ্ট জ্ঞান না-থাকা সত্বেও প্রবলভাবে নিজ নিজ পক্ষে কথা ও কাজ (তথা, performance) চালিয়ে যাচ্ছে।আর সেখানে বিতর্কের কেন্দ্রে মানুষ হিসেবে সমকামীদের বদলে আছে দল হিসেবে বিতর্ককারীরা কতটা ধার্মিক বা বিজ্ঞানমনস্ক সেই বাহাস।


অন্য যেকোন প্রাণীর মতো মানুষের মধ্যেও যৌনতা স্বাভাবিক একটা জৈবিক বিষয়। কিন্তু যৌনতার ভিত্তিতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামাজিক পরিচয় নির্ধারণের শুরু মোটামুটি ২০০ বছর আগে। মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিকদের মতে, ইউরোপে পুঁজিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে শৃংখলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদেরকে যেসমস্ত নিয়মনীতির অধীনস্ত করা হয়, তার একটা ছিল শুদ্ধ যৌনাচার। ব্যক্তির যৌনাচারকে সমাজস্বীকৃত উপায়ে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সীমিত করার মধ্য দিয়ে যাবতীয় যৌন-সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তা এবং প্রয়াসকে সীমিত করে। এভাবে ব্যক্তির শ্রমকে যথাসম্ভব শিল্পের উৎপাদনে নিয়োজিত করে সমাজ পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করে। ভিক্টোরিয়ান যুগের ইউরোপে যৌনাচার সম্পর্কিত সামাজিক রীতি নীতির পর্যালোচনা করে মার্ক্সিস্টরা এই সিদ্ধান্তে আসেন।


১৯ শতকের শেষভাগে এবং বিংশ শতকের শুরুতে যৌনবিজ্ঞান (sexology) নামের একটা স্বতন্ত্র্য বিজ্ঞানের অবির্ভাব হয়। যৌনবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মধ্য দিয়ে এই ধারণাসমূহ প্রতিষ্ঠা করেন যে, যৌনতা মানুষের ক্ষুধা, নিদ্রা, ইত্যাদির মতোই আরেকটা স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা, এটি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সমস্ত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত, এবং ব্যক্তি স্বভাবগতভাবেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট। আধুনিক যৌনবিজ্ঞানের এই জ্ঞান বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে উৎপত্তি লাভ করেছে সত্য। কিন্তু উত্তরাধূনিক তাত্ত্বিকরা এইরূপ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মধ্যেও সামাজিক মূল্যবোধের উপস্থিতি চিহ্নিত করেছেন। যেমন, কোন কোন যৌনবিজ্ঞানী গবেষণার মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান দিয়ে সমাজে বিদ্যমান নানান ধরণের যৌনাচারের বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণার অপসারণ করতে চেয়েছেন, কেউ বা গণস্বাস্থ্য এবং জাতীয় স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবদান রাখতে চেয়েছেন, এমনকি কেউ কেউ জাতিবর্ণের শুদ্ধতা সংরক্ষণের মত উগ্র জাতীয়তাবাদেও যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা সমাজে বর্ণবাদের প্রভাব কমে গেলে যৌনবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তির যৌন চাহিদার স্বীকৃতি এবং তৃপ্তির মাধ্যমে সুখী পারিবারিক জীবন গঠনে জোর দেয়। যৌনতার নানান দিক নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে যৌনতাকে প্রেম ও বিয়ের স্বাভাবিক ভিত্তি হিসেবে পশ্চিমা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে।


যৌনতা বিষয়ক আলোচনার অনিবার্যভাবে এসে যায় সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাম। যৌনবিজ্ঞানীরা যেখানে জন্মদান ও বিপরীতকামকে (heterosexuality) যৌনতার স্বাভাবিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন, ফ্রয়েড সেখানে দাবি করেন যে যৌনতার মূল লক্ষ্য আনন্দ উপভোগ। এরফলে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক যৌনাচারের সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ফ্রয়েডের মতে, জন্মদানের বাইরেও নানা প্রকার যৌনাচারের মাধ্যমে আনন্দ লাভ সম্ভব। কিন্তু জন্মদানের সক্ষম অল্প কিছু যৌনাচারই (যেমন, দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে নারীপুরুষের মিলন) কেবলমাত্র স্বাভাবিক হিসেবে সমাজের স্বীকৃতি পায়। আর ব্যক্তি কি উপায়ে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে তা’ দিয়ে প্রভাবিত হয় ব্যক্তিসত্বা।


যৌনবিজ্ঞান যেখানে প্রচলিত সমাজস্বীকৃত যৌনাচারগুলোকে নির্মোহ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে, নারীবাদীরা সেগুলোকে অনিবার্যভাবেই ব্যক্তির লৈঙ্গিক পরিচয়ের দ্বারা প্রভাবিত বলে চিহ্নিত করে। তাদের মতে, সমাজে ব্যক্তিমাত্রই একটা নির্দিস্ট লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে বিদ্যমান যা নির্ধারণ করে তাদের যৌনাচার। আর ব্যক্তি লিঙ্গ পরিচয় আত্মস্থ করে কিছু সুনির্দিস্ট সামাজিক প্রক্রিয়া (যথা, শিক্ষা) আর কখনো কখনো সামাজিক শাসনের মধ্য দিয়ে। তারা আরও দাবি করে যে, সমাজে নারী-পুরুষের যৌনাচারের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যগুলো জৈবিক কোন বিষয় নয়। বরং, এগুলো বিপরীতকামের (heterosexuality) ভিত্তিতে সংগঠিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অবদান। ফলে তারা নারীর যৌন-স্বাধীনতা দাবি করেন। তবে লক্ষণীয় যে, নারীবাদীদের যৌনস্বাধীনতার দাবি ব্যক্তির যৌনতাকে সমাজের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নয়। বরং সামাজিক রীতিনীতর মধ্যে থেকেই ব্যক্তির স্বাধীনভাবে যৌন-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার জন্য নারীবাদের লড়াই। কারণ, কোনপ্রকার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ না-থাকলে যৌনতা যে সহিংসতা বা অনাকাংখিত গর্ভধারণের মতো সমস্যার দিকে নিয়ে যায়, তা সম্পর্কে নারীবাদীরা সচেতন।


১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীরা যৌনাচারকে একটা বিশেষ মোরালিটির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন যা’ শুধুমাত্র দাম্পত্য প্রেমের ভিত্তিতে গড়া বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যকার যৌনাচারকে স্বাভাবিক বলে স্বীকৃতি দেয়। আর ব্যক্তিকে এই মোরালিটি শিক্ষা দেওয়া হয় সুনির্দিস্ট কিছু নিয়মনীতির মাধ্যমে। এগুলোই নির্ধারণ করে কোন ব্যক্তি কার সাথে, কখন, কোথায়, কিভাবে যৌনাচারে অংশ নিবে, অথবা এড়িয়ে চলবে। বৃটিশ সমাজবিজ্ঞানী Ken Plummer যৌনাচার সম্পর্কিত একটা লেবেলিং তত্ত্ব প্রদান করেন যা’র মধ্য দিয়ে তিনি দেখান যে, ব্যক্তি সমকামী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, বরং সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সমকামীতার শিক্ষা লাভ করে। Social Construction of Reality ঘরানার এই ধারায় সবথেকে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Jeffrey Weeks যৌনাচারের সামাজিক প্রকৃতি নিয়ে দাবি করেন যে, (১) ব্যক্তির যৌনাচারকে সমাজের থেকে আলাদা এবং সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে অনুমান করা একটা ভ্রান্ত ধারণা, (২) সমাজে যৌনতার ধরণ, যৌনতা-বিষয়ক বিশ্বাস ও মতবাদ, এবং যৌনাচারের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান, এবং (৩) আমাদের অবশ্যই পাঠ করতে হবে সমাজ কিভাবে নানান জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যৌনাচার উৎপাদন করে।

যৌনবিজ্ঞানকে সবথেকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করেন মিশেল ফুকো। যৌনতা একটা জৈবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় বলে যৌনবিজ্ঞানীদের দাবিকে ফুকো নাকচ করেন এই বলে যে, যৌনাচার প্রত্যয়টি এবং এর সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই (ফুকোর পরিভাষায়, ডিস্কোর্স) যৌনতা নিয়ে যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের কারণ। তার মতে, মানুষ যৌন-জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেনা। কিন্তু সমাজই তাকে যৌনতা সম্পর্কে সচেতন এবং আগ্রহী করে। তিনি আরও দাবি করেন যে, যৌন-মানস গড়ে ওঠে শুধুমাত্র সেইসব সমাজে যেখানে যৌনতার একটা সুনির্দিস্ট সামাজিক ধারণার উদ্ভব হয়েছে। The History of Sexuality গ্রন্থে ফুকো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের ইতিহাস (যেমন, মনোবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ইত্যাদি) বিশ্লেষণ করে দেখান যে, আধুনিক ইউরোপীয় সমাজ যৌনতা বিষয়ক সত্য উদ্ঘাটনে এতোটাই নিমগ্ন যে, তারা যৌনতাকেই বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। সেই আধুনিক সমাজে নানান জ্ঞান-উৎপাদনকারী সামাজিক প্রতিষ্ঠান যৌনতাকে এমনভাবে নির্মাণ করেছে, যেখানে ব্যক্তির যৌনতার মধ্য দিয়ে তার ব্যক্তিসত্বা, গোপন অভিলাষ, তার মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগময়তা, প্রভৃতি একান্ত গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশিত হয় বলে অনুমান করা হয়। অর্থ্যাৎ, ব্যক্তির যৌনাচার অবশ্যম্ভাবীরূপে তার ব্যক্তিসত্বার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। এইখান থেকেই শুরু হয় যৌনাচারের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মপরিচয় নির্মাণ ও বিনির্মাণ, তথা পরিচয়ের রাজনীতি।


আধুনিক ইউরোপে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শহুরে শিল্পসমাজে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় ফুকো লক্ষ্য করেছেন যে, রাষ্ট্র দ্রুতহারে বর্ধমান নাগরিক সমাজে সকল ব্যক্তির সম্পর্কে নানা ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ (যেমন, অভিবাসন, গণস্বাস্থ্য, জন্ম-মৃত্যু, শ্রমবাজার, ইত্যাদি) এবং তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অনুভব করে। এরথেকেই ঘটনাক্রমে জন্ম নেয় আধুনিক যৌনতার বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা ও জ্ঞান। তিনি দেখান কিভাবে এই যৌন-বিষয়ক জ্ঞান সামাজিক নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থার মূল হিসেবে আধুনিক সমাজে বিদ্যমান।


ব্যক্তির যৌনতার উপর সমাজের এই নিয়ন্ত্রকে ফুকো নিবর্তনমূলক হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিলোপ চেয়েছেন। তিনি সমাজের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যক্তির মুক্তি চেয়েছেন বলে সমকামীদের অধিকারকেও সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মনে করেন যে, যৌনতাকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে সমকামের অধিকারই যথেষ্ট নয়। কারণ, তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, সমকামে ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তির প্রকৃত মুক্তি নিয়ে আসেনা। কারণ, সমকামিতা নিজেই একটা সামাজিক পরিচয় (social identity) হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং দলভুক্ত ব্যক্তির স্বাধীনতাকে খর্ব করে।


নারীবাদী দার্শনিক Judith Butler দেখান যে, সমাজে প্রচলিত যৌন-বিষয়ক Norm বা রীতিনীতি ব্যক্তি স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে চলে। আর যখন কোন ব্যক্তি তা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে, তখন তাকে সামাজিক চাপের মুখে পরতে হয়। এটি স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিপরীতকামী (heterosexual) ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়, একইভাবে সমকামীদের মধ্যেও দেখা যায়। সমকামী (homosexual) সামাজিক পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিদেরকে তাদের নিজ নিজ দলে বিশ্বাস ও আচার-আচরণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তারমানে, ব্যক্তির যৌনাচার তার প্রকৃত স্বত্বার বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং ব্যক্তিসত্বা সমাজের স্বীকৃত এবং প্রচলিত রীতিনীতি মোতাবেক যৌনাচরণের (performance) মধ্য দিয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের প্রয়াস পায়। অর্থ্যাৎ, ব্যক্তির যৌনাচার তার প্রকৃত স্বত্বার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং সমাজে বিদ্যমান নানান জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদিত ও নিয়ন্ত্রিত “স্বাভাবিক” (তথা সুস্থ) এবং “অস্বাভাবিক” (তথা অসুস্থ বা অসামাজিক) আচার-আচরণ।




বলেছিলাম, সমকামিতা নিয়ে বিদ্যমান বিতর্কে সমকামী হিসেবে পরিচিত মানুষের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষা করার কথা। তারজন্য সবার আগে দরকার সমকামের বিতর্কের মধ্য থেকে পরিচয়ের রাজনীতিকে বিদায় করা। কারণ, এই বিতর্ক দিয়ে আপনার/আমার নিজের ধার্মিকতা বা মুক্তমনা পরিচয়ের লাভ হলেও সমকামীদের কোন লাভ হচ্ছেনা। কাজেই, সর্বাগ্রে এই পরিচয়ের রাজনীতি সরিয়ে দিয়ে সমকামী ব্যক্তিদেরকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিন। তারপর, ধার্মিকতার পাটাতন থেকে যারা সমকামীদের আচার-বিশ্বাসকে বাতিল করছেন, তারা স্মরণ করুন ধর্মের এই নীতি যে, “পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।” আর বিজ্ঞানমনস্করাও কল্পিত বৈজ্ঞানিক বা জেনেটিক প্রমাণের জোরে সমকাম এবং সমকামীদেরকে স্বাভাবিকজ্ঞান করতঃ তাদের মানবাধিকারের দাবির পরিবর্তে বরং সকল ব্যক্তির মানবাধিকারের দাবীতে সোচ্চার হন। দলমত নির্বিশেষে মানবাধিকারের জন্য আপনাদের সেই লড়াই থেকে সমাজের সকলেই সমানভাবে উপকৃত হবে।






298 views0 comments

Recent Posts

See All

‘বাঙালি মুসলমানের মন’: গোঁজামিলের এক জ্ঞানবৃক্ষ

১ জাতীয় পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা আছে, আছে তার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ। মোটাদাগে, জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়...

Comments


bottom of page