top of page
  • Hasan Mahmud

লেখাচুরি (plagiarism) নিয়ে কিছু দরকারি কথা

Updated: Jun 16, 2020


Image: Courtesy of Wikimedia Commons


২০১৫ সালের মে মাসে আমেরিকার একাডেমিয়াতে বেশ একটা ঝড় বয়ে গেছে University of California Los Angeles (ইউসিএলএ) থেকে সদ্য পলিটিক্যাল সায়েন্স এ পিএইচডি সমাপ্ত করে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের অপেক্ষায় থাকা মাইকেল লা’ক (Michael LaCour) এর লেখাচুরি বা প্লাজিয়ারিজম এর কাহিনী উম্মোচিত হলে। গত ডিসেম্বরে সুপ্রসিদ্ধ একাডেমিক জার্নাল ‘Science’ মাইকেলের একটা আর্টিকেল প্রকাশ হয়েছিল কিভাবে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান কন্টাক্ট মাইনরিটিদের প্রতি কুসংস্কার (prejudice) হ্রাস করে এই বিষয়ে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই জানা গেলো যে, এই আর্টিকেলের বেশ কিছু তথ্য আরেকটা স্টাডির তথ্যের সাথে হুবহু মিলে যায়!- যথারীতি মাইকেলকে প্রশ্ন করা হয় এ সম্পর্কে এবং সে সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে Science জার্নাল থেকে আর্টিকেলটা প্রত্যাহার করা হয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ও মাইকেলকে অধ্যাপনার পদে যোগদানের প্রস্তাব ফিরিয়ে নেয়। মাইকেল লা’ক স্ক্যান্ডাল

২০১৪ সালের মাঝামাঝি লেখাচুরির আরেকটা বিশাল ঘটনা উম্মোচিত হয় জাপানে। সেখানে হার্ভার্ড থেকে গবেষণা করা হারুকো ওবোকাতা (Haruko Obokata) নামের এক বিজ্ঞানী স্টেমসেল নিয়ে সাড়া জাগানো দুটো আর্টিকেল প্রকাশ করে সবথেকে বিখ্যাত একাডেমিক জার্নাল ‘nature’ এ, যা’ তাকে রাতারাতি সেলিব্রিটি বিজ্ঞানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। পরে দেখা যায় যে, তার আর্টিক্যালগুলো লেখাচুরিসহ আরও অন্যান্য একাডেমিক অসততার দোষে দুষ্ট। ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হওয়া এই তারকার পতনও হয় একই রকম দ্রুততায়। হারুকো ওবোতাকা স্ক্যান্ডাল

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে গবেষণা করে সুপ্রসিদ্ধ একাডেমিক জার্নালে পাবলিশ করা আর্টিকেলে যদি লেখাচুরির বিষ পাওয়া যায়, তাহলে অন্যগুলোতে কি অবস্থা তা’ সহজেই অনুমেয়। লেখাচুরির ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য আরও কিছু তথ্য উল্লেখ করলে বোঝা সহজ হবে। Cunninghum (2011) আমেরিকার হাইস্কুল পর্যায়ের বিজ্ঞানমেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক গবেষণায় পেয়েছেন যে, তাদের ৬০% লেখাচুরিসহ আরও কয়েক ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। Sperber (2000) এর গবেষণার ফলাফল আরও ভয়াবহ- আমেরিকার কলেজ ছাত্রদের (আন্ডারগ্র্যাড) মধ্যে ৯০% এরও অধিক একাডেমিক প্রতারণার আশ্রয় নেয়। আরেক গবেষণা এই দোষ অর্ধেকের বেশি গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল (McCabe, Butterfield, and TRevino, 2006)। একাডেমিক প্রতারণার সমস্যা কিন্তু আজকের না, অনেক আগে থেকেই ছিল। ঐতিহাসিক হেলেন হরোউইজ (Helen Horowitz, 1987) দাবী করেন যে, শতবছর আগে আমেরিকার প্রসিদ্ধ কলেজ+বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্ররা এসব কুকাম করত। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৬০-এর দশকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্র তাদের এসাইনমেন্ট অন্যদের দিয়ে লিখিয়ে নিত।

একাডেমিক প্রতারণায় অন্যান্য দেশের কীর্তিমানেরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। যেমন, Vogel (2011) নেদারল্যান্ডের এক বিজ্ঞানীর ডজনখানেকেরও বেশি আর্টিকেলে প্রতারণা খুঁজে পেয়েছিলেন। আর কেউ যদি মনে করে থাকেন যে, এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশীরা পিছিয়ে আছি, তাইলে সেই ভুল ভাঙ্গানোর জন্য এমন একটা কাহিনী মনে করায়ে দেই- ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক মোহাম্মদ নূরুদ্দীন তার পিএইচডি ডিগ্রী হারান এইজন্য যে, তিনি ১৩ লাখ মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বলে দাবী করেছিলেন। (তার চাকরী গেছে না আছে তা’ অবশ্য জানিনা) ঢাবি’র শিক্ষকের গবেষণায় প্রতারণা



একাডেমিক প্রতারণাগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি হচ্ছে লেখাচুরি। লেখাচুরি বা plagiarism শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ plagium যার অর্থ হল ‘kidnapping a man’। সহজ কথায়, লেখাচুরি হচ্ছে অন্যের গবেষণা/লেখা থেকে নিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া। World Association of Medical Editors (WAME) এর মতে, যদি কোন একটি লেখায় অন্য লেখা থেকে ছয়টি (০৬) শব্দ পরপর মিলে যায়, বা যদি ৩০টি শব্দের সেট হতে ৭ থেকে ১১ টি শব্দ মিলে যায়, তাহলে প্রথম লেখাটি লেখাচুরি বা প্লাজিয়ারিজমের দোষে দুষ্ট। তবে শুধুমাত্র সরাসরি টুকলিফাই না-করেও যদি কেউ অন্যের গবেষণা ফল বা আইডিয়া এদিক-সেদিক খানিকটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লিখে নিজের বলে চালিয়ে দেয়, সেটাও কিন্তু প্লাজিয়ারিজম। এমনকি কেউ নিজের গবেষণা ফল বা আইডিয়াও আগে কোথাও প্রকাশ করার পর আবার অন্যকোথাও ‘নতুন’ হিসেবে প্রকাশ করলে সেটাও প্লাজিয়ারিজম (Masic, 2012)। সম্প্রতি শেষোক্ত প্রকারের লেখাচুরির অভিযোগ উঠেছে বর্তমানে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী বাউম্যানের বিরুদ্ধে। এখানে

তাহলে কি ইতোমধ্যেই প্রকাশিত অন্যের/নিজের লেখা থেকে কাট/কপি+পেস্ট করা যাবেনা? এমনকি অন্যের কথাকে হুবহু না-নিয়ে একই বক্তব্যকে নিজের ভাষাতেও লিখা যাবেনা? অবশ্যই এটা করা যাবে। ইনফ্যাক্ট, একাডেমিক আর্টিকেলে পূর্বে প্রকাশিত বিষয় সংশ্লিষ্ট লেখা থেকে তথ্য বা বক্তব্য নিয়ে নিজের লেখার বক্তব্যকে শানিত করাই প্রচলিত রীতি। তবে তা করতে সুনির্দিষ্ট রীতি আছে। সেই রীতি মেনেই অন্যের লেখা থেকে নেওয়া যাবে। যেমন, অন্য লেখা থেকে হুবহু কোন বাক্য বা বাক্যাংশ নিলে সেটাকে “” বা ” এর মধ্যে রেখে সাথে সাথেই লেখকের নাম+প্রকাশের সাল+পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করতে হয়। আবার অন্য লেখা থেকে সরাসরি কপি/কাট+পেষ্ট না করে মূল বক্তব্য/ভাবটাকে নিয়ে নিজের মতো করে লিখলে (অর্থ্যাৎ, যাকে আমরা বলি প্যারাফ্রেজিং) সেই বাক্যের শেষে লেখকের নাম+প্রকাশের সাল উল্লেখ করতে হয়। (কিছু কিছু জার্নাল খানিকটা আলাদা রীতিও অনুসরণ করে, তবে সেটাও সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই)। এই রীতি না মেনে, যথাযথভাবে রেফারেন্স না দিয়ে অন্যের লেখার অংশবিশেষকে নিজের লেখায় অন্তর্ভুক্ত করলেই তাকে বলা হয় প্লাজিয়ারিজম বা লেখাচুরি। (আমিন এবং হায়দারের প্রশ্ন থেকে মনে হল এই প্যারাটা সংযোগ করাটা জরুরি)।

লেখাচুরি ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত- দুইই হতে পারে। কিন্তু ইনটেনশন যা’ই হোক, লেখাচুরি একটা প্রতারণা, এবং এজন্য একে একাডেমিক অসততা হিসেবেই দেখা হয়। আর অসততার জন্য যেমন প্রাপ্য, তা’ই দেওয়া হয় এই দোষে দুষ্টদেরকে। ধরা পড়লে কারোই রেহাই নেই, আমেরিকাতেই হোক আর ইউরোপেই হোক। তবে বাংলাদেশে দুএকটা লেখাচুরির আকাম ধরা পড়লেও অধিকাংশই অনুৎঘাটিত থেকে যায়। আমি নিশ্চিত করে জানি ঢাবি’র একাডেমিক পত্রিকায় ডজনখানেক আর্টিকেলের প্লাজিয়ারিজমের কাহিনী- এরমধ্যে এমনও আর্টিকেল আছে যেগুলো শিক্ষকের নামে প্রকাশিত হলেও আসলে সেগুলো ছাত্রদের করা এসাইনমেন্ট! আর ছাত্রদের এমএ থিসিস থেকে আর্টিকেলে শিক্ষক নিজে কোন কিছু না-করেও প্রথম-অথোর হিসেবে প্রকাশ করার ঘটনা ত অহরহই ঘটছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কি অবস্থা জানিনা, তবে অনুমান করি সেখানে আশাহত হওয়ার মতই হবে লেখাচুরি এবং অন্যান্য একাডেমিক অসততার ব্যাপ্তি।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় ব্লগে লেখাচুরি এবং এর প্রতিরোধে মনোযোগ কম থাকা অস্বাভাবিক নয়। ফলে ব্লগগুলোতে এই সমস্যার মাত্রা অধিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সিসিবিতে প্রকাশিত এই এবং এই ব্লগগুলো আমার এই অনুমানকেই সমর্থন করে। এই দুইটা লেখা সামহোয়্যারইন ব্লগেও প্রকাশিত এবং বেশ সমাদৃত হয়েছে। ব্লগের পাঠকরা লেখাচুরি নিয়ে ততোটা সচেতন নয়, যতটা পেশাদার একাডেমিকরা। তবে সিসিবি এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম। এখানে উল্লিখিত ব্লগদুটোতে লেখাচুরি খুঁজে পাওয়া এবং সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করায় সিসিবিয়ানদের মধ্যে যে ঐক্য দেখা গেছে, তা’ বাংলা ব্লগের জগতে একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ব্লগের মডারেশন প্যানেলও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়ে সেই প্রতিবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। আশা করি, এরপর থেকে সকলেই লেখাচুরি থেকে বিরত থাকবে, অন্তত সিসিবিতে।



খুঁজলে হয়তো আরও দু’একজনকে পাওয়া যেতে পারে, তবে আমার জানামতে সিসিবি’তে ডঃ রমিত আজাদ ভাই’ই লেখাচুরির অপরাধে সনাক্ত প্রথম ব্যক্তি। লেখাচুরির অভিযোগের জবাবে তিনি উল্লিখিত একটা পোস্টে একাধিকবার অভিযোগ খণ্ডানোর প্রয়াস পেয়েছেন এই বলে যে, তিনি ইচ্ছে করেই উদ্ধৃতি দেননি পাঠকদের পড়ার সুবিধার্থে, চাইলেই সেগুলো দিতে পারবেন অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের। কিন্তু উপরে উল্লেখ করেছি যে, অন্যের গবেষণা ফল/ধারণা/লেখার অংশবিশেষ নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইনটেনশন যা’ই হোক, সেটা লেখাচুরি। আর লেখাচুরি হচ্ছে একাডেমিক অসততা, অর্থ্যাৎ অপরাধ।

রমিত ভাই, কোথাও আপনি লেখাচুরির এই অপরাধ স্বীকার করেছেন চোখে পড়েনি- না সিসিবিতে, না সামহোয়্যারইন এ। আপনি লেখাচুরি কি সেটা জানেননা মনে করা কঠিন। আর যদি ধরেও নিই যে আপনি এ’ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না, এক্ষণে এই অনুমান বাতিল হয়েছে। কারণ, ইতোমধ্যেই আপনার জানা হয়ে যাওয়ার কথা লেখাচুরি কি আর এর পরিণামই বা কি। একজন পিএইচডিধারী গবেষক হিসেবে+বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের একাডেমিক ইন্টেগ্রিটির পরিচয় দিতে হলে কৃত অপকর্মের দায় স্বীকার করে যথাযথ বিবেচনার পরিচয় দিন।



তথ্যসূত্রঃ

Cunninghum, Sara (2011) Manual High students’ projects raises issue of fair play in science, Louisville Courier-Journal (April 4).


Horowitz, Helen (1987). Campus Life: Undergraduate cultures from the eighteenth century to the present. New York: Knopf.


Masic, Izet (2012). Plagiarism in Scientific Publishing. Acta Informatica Medica, 20(4): 208-213.

McCabe, Butterfield, and Trevino (2006). Academic Dishonesty in Graduate Business Programs: Prevalence, causes and proposed action. Academy of Management Learning and Education, 5:294-305.


Sperber, M. (2000). Beer and Circus: How big-time college sport is crippling undergraduate education. New York: Henry Holt.


Vogel, Lise (2011). Psychologist Accused of Fraud on “Astonishing Scale”. Science, 344(4):579.


#আলোচনা

#একাডেমিক

#প্রতারণা

#প্লাজিয়ারিজম

#রংপুর

#লেখাচুরি


169 views1 comment
bottom of page