top of page
  • Hasan Mahmud

“হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি" - একটি নির্মোহ, একাডেমিক পর্যালোচনা

Updated: Oct 17, 2023


ছবিঃ মূল বইয়ের প্রচ্ছদ



প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত ডঃ গোলাম মুরশিদ যে বইটার জন্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় চিরস্থায়ী আসন অর্জন করেছেন, তা হল “হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” (২০০৫)। বই আকারে প্রকাশের আগে এর বেশ কয়েকটা অধ্যায় প্রথম আলো এবং ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেসময় বাংলা সাহিত্যের উপর লেখা অধ্যায়টি পড়ে পুরো বই সম্পর্কে বেশ আগ্রহ জেগেছিল। পিএইচডি শেষ করার পর একদিন হাতে পেলাম একটা কপি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়েও ফেললাম একটানে। পুরোটাই। জানলাম অনেক অজানা তথ্য। তবে মনে হলো বইটাতে ইতিহাস খানিকটা কম, ইতিহাসের গল্প বেশি


বইটার প্রত্যেকটি অধ্যায় আগ্রহী পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে। এইখানেই অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের সবথেকে বড় সাফল্য। আরেকটা হলো তথ্যসূত্রের ব্যাপকতা। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধ, সংবাদপত্র, নাটক, লোককথা, স্থাপত্যকলা, প্রভৃতির থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ’ই তথ্যের প্রাচুর্যই সম্ভবতঃ তার জন্য সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যা’ তিনি অতিক্রম করতে অনেক ক্ষেত্রে অসফল হয়েছেন


“হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি” বইটার অনেক সাফল্য আছে, গত পনেরো বছরে সেগুলো নিয়ে আলাপও হয়েছে বিস্তর। কাজেই, আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। এখানে বইটার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি কতোটা সঠিক ভাবে পাঠ করা যায়, আমি সেই দিকটার একটা নির্মোহ একাডেমিক আলাপ করতে চাই।



বই বা প্রবন্ধ যেটাই হোক, তা শুরু হয় একটা সুস্পষ্ট প্রশ্ন ধরে। তারপর সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করার মধ্য দিয়ে আলোচ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে তত্ত্ব (theory) এবং প্রপঞ্চ (concept) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তত্ত্ব আলোচ্য বিষয়ে বিদ্যমান জ্ঞানকে সংক্ষেপে পরিবেশন করে, এবং এর মাধ্যমে আমাদের জানাশোনার ঘাটতির দিশা দেয়। পাশাপাশি, এটি উত্তর খোঁজার পথও বাতলে দেয়। আর প্রপঞ্চ (এর পর থেকে কনসেপ্ট লিখবো, ঐটাই শুনতে ও পড়তে বেশি পরিচিত লাগে) তত্ত্বকে সাহায্য করে বিশদ জ্ঞান সংক্ষেপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে।


বইয়ের সূচনাতে মুরশিদ বলেছেন যে, তিনি বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে লিখবেন। “বাঙালির সংস্কৃতি” হচ্ছে এখানে মূল কনসেপ্ট, যার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করা জরুরী। এইটা মেনে নিয়েও মুরশিদ কোন সংজ্ঞা না দিয়ে পাঠককে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি সংস্কৃতি বলতে কি বুঝিয়েছেন তা বই পাঠের ভিতর দিয়ে বোঝা যাবে। আর এই বুঝে নেয়ার ব্যাপারটা পাঠকের জন্য সহজ করতে গিয়ে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যথা- বাঙালি সংস্কৃতি কোন খন্ডে খণ্ডে বিদ্যমান, ক্রমবিকাশমান এবং এটি বাংলা ভাষাভাষীদের। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম মুরশিদ বাঙালি সংস্কৃতির যে আবছা ধারণা সূচনাতে দিয়েছেন, তা থেকে বারেবারে সড়ে গেছেন, কিছু কিছু জায়গায় নিজের কথা নিজেই বাতিল করেছেন বা সন্দেহ পোষণ করেছেন। ফলে, আবছা সেই ধারণাটা পরিষ্কার হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়েছে। শুরু করি নামকরণ থেকে- বাংলা ভাষাকে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হিসেবে নিয়ে এর উন্মেষকালকে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির শুরু বলে গ্রহণ করেছেন। আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, ভৌগলিক সীমানায় বাংলা, জাতি হিসেবে বাঙালি আর তাদের ভাষা হিসেবে বাংলার উদ্ভব হয়েছে ১৫ শতক থেকে ১৮ শতকের মধ্যে। কিন্তু তারপরেও তিনি বাঙালি সংস্কৃতির বয়স হিসেবে এক হাজার বছর ধরে নিয়েছেন “সমস্ত বিতর্ক বাদ দিয়ে একটি পূর্ণ সংখ্যার খাতিরে” (পৃ-১৮)!


দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুরশিদ দেখিয়েছেন যে, মুসলিম সুলতানরা রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও “সতিক্যার অর্থে দেশ চলতে থাকে পুরনো হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনে” (পৃ-২৭)। আরও উল্লেখ করেছেন যে, সেসব মুসলিমরা “নিজেদের অবস্থা ফেরানোর জন্যই সুদূর বংগদেশ পর্যন্ত এসেছিলেন। ধর্মপ্রচার করে পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য তারা কেউ এদেশে আসেননি” (পৃ-২৯)। কিন্তু দুই পৃষ্ঠা পরেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে বাংলায় “মুসলিম শাসনের প্রথম শতাব্দীর ইতিহাস তরবারি দিয়ে দেশ শাসনের ইতিহাস” এবং এরপর জাফর খান কর্তৃক ত্রিবেণীতে মন্দিরের পাথর দিয়ে মসজিদ ও মাজার তৈরিকে উল্লেখ করেছেন “তরবারী দিয়ে ধর্ম প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য নজির” হিসেবে (পৃ-২৯)। দুটো অনুমান পারস্পরিক সাংঘর্ষিক- হয় বাংলা হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল, নতুবা তরবারি হাতে উদ্যত মুসলমান বিজেতাদের পদতলে ছিল যারা শাসনকার্যের পাশাপাশি ইসলামও প্রচার করতো। যেসব তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন, উপরে উল্লিখিতটি বাদে আর সবগুলোই আবার প্রথমটি, তথা দেশ হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল এই অনুমানকে সমর্থন করে। যেমন, পরের প্যারাতেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে, তাদের নামে এই স্থানীয় (হিন্দু) রাজা ও জমিদারেরাই দেশ শাসন করতেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে এই স্থানীয় হিন্দু রাজাদের ভূমিকা আগের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে (পৃ-৩৭)। এমনকি তরবারি দিয়ে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করার অনুমানে তিনি নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন (পৃ-৬৪)।


এখানে তিনি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন যে, বহিরাগত সেসব মুসলমান সুলতানরা প্রথম দুইশতক নামেমাত্র দিল্লীর সুলতানের অধীনতা স্বীকার করলেও প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবেই রাজ্য শাসন করতেন। আর এরা ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় এসেছিলেন বলে এখানেই স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে (জোর করে অথবা আর্থিক প্রলোভনের মাধ্যমে; কিন্তু তথ্যসূত্র নেই) স্থায়ী হয়ে গেছেন। ফলে দুই-তিন পুরুষের মধ্যেই এরা স্থানীয়দের সাথে মিশে যেতেন; অবশ্য তারা আভিজাত্য ধরে রাখার জন্য আলাদা ভাষা ব্যবহার করতেন। ১৪ শতকে সুলতান ইলিয়াস শাহের মাধ্যমে বাংলায় যে স্বাধীন সুলতানি আমল শুরু হয়, সেসময় বহিরাগত শাসকশ্রেণী এদেশীয়দের সাথে আরও মিশে যায়, দেশীয় রাজা+জমিদারদের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি পায়, এমনকি সুলতানরা বাংলা ভাষাকেও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এজন্য মুরশিদ মুঘল শাসন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে মুসলমান যুগ না বলে বহিরাগত মুসলমান আর স্থানীয় হিন্দু শাসকদের সম্মিলিত “ইন্দো-মুসলিম” আমল বলেছেন। তবে মুঘল আমলে এসে মুসলমান শাসকরা আবার নিজেদেরকে দেশীয়দের থেকে আলাদা করে ফেলে বলে এসময়কে মুরশিদ বাংলায় উপনিবেশিক শাসনের শুরু বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়- মুসলমানরা স্পষ্টতঃই বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল। কিন্তু হিন্দুরা কোথা থেকে? হিন্দুদেরকে মুরশিদ স্থানীয় বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু হিন্দুদের সবথেকে শক্তিশালী এবং সর্বশেষ রাজবংশ সেনরা ত’ নিজেরাই দাবী করত যে তারা কর্ণাটক থেকে, তথা বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল। মুসলমানরা যাদের হাত থেকে শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, তারা কি উপায়ে স্থানীয় হয়েছিল? তাদের আগে বাংলার বাইরে থেকে আগত বৌদ্ধরা শাসনক্ষমতায় ছিল কয়েক শতাব্দী, তারাই বা কি উপায়ে স্থানীয় হলো? অথবা বাংলা থেকে বিতাড়িত হলো বা হারিয়ে গেল? পরবর্তী অধ্যায়ে মুরশিদ প্রাচীন বাংলার সমাজ ও ধর্মের ইতিহাস আলোচনার মধ্যে দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।


বাংলার সমাজ ও ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে মুরশিদ যে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তাকে এককথায় বলা যায় বহিরাগতদের সাথে বাংলার আদিবাসীদের সমন্বয়। বহিরাগত আর্য এবং তাদের বৈদিক ধর্ম, কৃষি, বর্ণপ্রথা, বৌদ্ধ ধর্ম ও তাদের সমাজব্যবস্থা, মুসলমান ও তাদের ধর্ম প্রায় এক হাজার বছর ধরে ক্রমাগত একে অপরের সাথে মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির। কিন্তু তিনি আলোচনায় যতগুলো তথ্য ব্যবহার করেছেন, তার সবগুলোই হয় বৌদ্ধ থেকে হিন্দু ধর্মে (মৌর্য থেকে গুপ্ত যুগে) বা হিন্দু থেকে বৌদ্ধ ধর্মে (পাল যুগে), আবার হিন্দু ধর্মে (সেন যুগে) এবং সর্বশেষে ইসলাম ধর্মে (সুলতানি যুগে) পরিবর্তনের কথা। এখানে আদি যারা ছিল, তাদের কি অবস্থা? নাকি আদৌ কোন জাতিগোষ্ঠী ছিলই না, লোকেরা বাইরে থেকে বিরান বাংলায় এসে বসতি গেড়েছিল?


বৌদ্ধ ধর্ম থেকে ঠিক কি উপায়ে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল মুরশিদ তা ব্যাখ্যা করেছেন এই দুইয়ের সমন্বয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল মুরশিদ সেটা বলেননি। অথচ, হিউয়েন সাঙের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে হিন্দু রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিতাড়িত করার কথা (পৃ-৫২)। বৌদ্ধ আর হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ের বর্ণনায় হিন্দু শাসকদের জোরজবরদস্তির কথা চেপে গিয়ে আর মুসলমান শাসকদের সময়ে সেগুলোর উল্লেখের মাধ্যমে মনে হয় মুরশিদ একটা অনুমান প্রস্তাব করেছেন যে, বাংলায় ইসলামধর্মের বিস্তার ছিল জবরদস্তিমূলক, যা’ আবার তারই পূর্বের অনুমানের (তথা মুসলমানরা বাংলায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেনি) বিরোধিতা করে


বাঙালি সংস্কৃতির শুরু হিসেবে মুরশিদ সেনযুগকে ধরেছেন (পৃ-৫৮)। কিন্তু কেন? তিনিই ত উল্লেখ করেছেন যে, সেনরা দক্ষিণ ভারত থেকে আগত এবং বাংলায় তারা সেখানকার বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকেই বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া সেন রাজারা বাংলা নয়, বরং সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিল (পৃ-৫৯)। অর্থ্যাৎ, বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা সেসময় হয়নি। আর আগে ত’ অবশ্যই নয়। তাহলে ঠিক কোন সময়কে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির সূচনা বলে গ্রহণ করবো?


এই অধ্যায়ে সবথেকে বিভ্রান্তিকর বিষয় হলো ইসলামের আগমন নিয়ে মুরশিদের বয়ান। বিভ্রান্তিকর বলছি কারণ তার বয়ান স্ববিরোধীতায় পূর্ণ। যেমন, শুরুতে মুসলমান সুলতানরা বাংলায় ইসলাম প্রচার করতে আসেননি উল্লেখ করেছেন, হিন্দু মন্দিরের জন্য জমিদান করার কথা বলেছেন, বৌদ্ধবিহার ও মন্দির ধ্বংসের রাজনৈতিক ও আর্থিক লাভের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এসবের সমর্থনে তিনি রিচার্ড ঈটন আর অসীম রায়ের মতো ঐতিহাসিকের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। তারপরেও বলেছেন যে, “মুসলমান রাজত্ব স্থাপনের বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে বাংলার ধর্মবিশ্বাসের উপর এমন প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে আঘাত করেছিলো, তার আগেকার হাজার বছরের মধ্যে যার কোন তুলনা ছিল না” (পৃ-৬২)। আবার বলেছেন, মুসলমানদের আগমন আর্য বা সেনদের মতো নিঃশব্দে বা ধীরে হয়নি। কিন্তু পরের প্যারাতেই ইসলামের আগমন উপ-অধ্যায় শেষ করেছেন এই সিদ্ধান্ত টেনে যে, “ইসলাম ধর্ম তড়িৎ গতিতে নয়, পূর্ববঙ্গ-সহ বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে (পৃ-৬৩)।

স্ববিরোধীটার সমস্যা আরও দেখি বঙ্গে ইসলাম ধর্ম প্রসারের কারণ আলোচনায়। মুরশিদ প্রথমে বাংলায় ইসলাম প্রসারের চারটি মতবাদের কথা উল্লেখ করেছেন- রাজশক্তির জোরে জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর, ইসলামের সামাজিক সাম্য তথা বর্ণভেদ না-থাকায় নিম্নবর্ণের লোকেদের দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, বাইরে থেকে মুসলমানদের দলে দলে বাংলায় আগমন, এবং পীর দরবেশদের মাধ্যমে ব্যাপক ধর্মান্তর। তিনি সুনির্দিষ্ট সূত্র উল্লেখ করেননি, কিন্তু এই চারটিই বিস্তারিতভাবে এবং সুবিন্যস্তভাবে আলোচনার মাধ্যমে বাতিল করেছেন রিচার্ড ঈটন (১৯৯৩), যার কথা মুরশিদ এই বইয়ের এখানে সেখানে কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। অসীম রায়ও এগুলো আলোচনা করে এগুলোকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। তাদেরকে উল্লেখ না-করে মুরশিদ নিজের মত করে এই মতবাদগুলো আলোচনা করেছেন এবং বাতিল করেছেন। আর এই করতে গিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে মুসলমান শাসকদেরকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হিন্দু-নিপীড়ক হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন, তিনি জবরদস্তিমূলক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর মতবাদের আলোচনায় অধিকৃত এলাকায় মন্দির তৈরি না-হওয়াকে সুলতানদের মুর্তিপূজা বিরোধিতার প্রমাণ হিসেবে অনুমান করেছেন (পৃ-৬৪), পরাজিত রাজা/জমিদারকে ইসলামগ্রহনের শর্তে মুক্তিদান বা দাক্ষিণ্য বিতরণের নামে হিন্দুদের ধর্মান্তর (পৃ-৬৮), স্থানীয় মেয়েদেরকে ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক বিয়ে (পৃ-৬৯), যেগুলো আদতে বিজয়ী শাসককর্তৃক জোরপূর্বক ধর্মান্তরেরই নামান্তর। তারমানে, মুরশিদ কি একই সাথে ‘রাজশক্তির জোরে জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর’ মতবাদকে গ্রহণ ও বর্জন করছেন?


এই অংশে আমার সবথেকে বড় অস্বস্তি হলো- পীর ও দরবেশদের প্রচারের মাধ্যমে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাখ্যাটা মুরশিদ নিশ্চিত ভাবেই রিচার্ড ঈটনের the Rise of Islam and the Bengal Frontier (১৯৯৩) বই থেকে নিয়েছেন। ঈটনের বই পড়েছে এমন যেকেউই ব্যাপারটা বুঝবে। কিন্তু মুরশিদ সেটা স্পষ্ট করে কোথাও উল্লেখ করেননি, যা’ গবেষণা প্রকাশনায় একটা স্বীকৃত রীতির বরখেলাফ। ঈটনের বইটার মূল ফোকাসই হল বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা কিভাবে বেড়ে গিয়েছিল তা’ ব্যাখ্যা করা এবং তিনি ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা উত্তর প্রদান করার কাজটিই করেছেন। কিন্তু মুরশিদ সেই অংশকে বাদ দিয়েছেন, কেন তার কোন কৈফিয়ত না-দিয়েই। স্পটতঃই তিনি ঈটনের বই পড়েছেন। কিন্তু তার বক্তব্যকে মুরশিদ কিসের ভিত্তিতে খণ্ডন করেছেন এবং ফলশ্রুতিতে নিজে আরেকটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা’র কোন আলোচনা উপস্থাপন করেননি।


আমার মনে হয়, মুরশিদ তার বইয়ে বাংলাকে অখণ্ড এবং আবহমান কাল ধরে রূপান্তরের ধারায় চিত্রিত করতে চেয়েছেন বলেই তিনি ঈটন প্রদত্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান সমাজের উদ্ভবের প্রক্রিয়াটা ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ মুরশিদ যখন বাংলার রেনেসাঁ, বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ এবং দেশবিভাগের আলোচনা করেন, সেখানে মূলতঃ পশ্চিম বাংলা এবং কলিকাতাকে দেখি, পূর্ববঙ্গ আসে কেবলমাত্র আলোচলার অনুষঙ্গ হয়ে, মূল ফোকাসে নয়। বাঙালির প্রণয়, পরিণয় ও পরিবারের আলোচনায়ও প্রধানত কলিকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্তের আলোচনা দেখি। সম্ভবতঃ একই কারণে পূর্ববাংলার মুসলমানের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাকে মুরশিদ “বাংলা সংস্কৃতি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার ভিত্তি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (পৃ-১৮৯)! অথচ তিনি নিজেই নানারকম তথ্য দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিরাই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরকে বাঙালি বলে স্বীকার করত না। শুধু হিন্দুরাই নয়, এমনকি নের্তৃস্থানীয় মুসলমানরাও পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলমানদেরকে বাঙালি মনে করতো না। একইভাবে, বিদেশী পর্যটকরাও নানা সময়ে বাংলার যে বিররণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সেখানে বাঙালি হিন্দু এবং অভিজাত মুসলমানদের থেকে আলাদা করে উল্লেখ করে গেছেন। কেন এরা সকলেই পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরকে বাঙালি বলে মনে করেনি? আর মুরশিদই বা কেন এই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে দুই বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদেরকে এক অখণ্ড বাঙালি জাতি হিসেবে উপস্থাপন করলেন? কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এমন করলেন তার কোন ব্যাখ্যা তিনি বইয়ের কোথাও দেননি।




রিভিউ ইতোমধ্যেই অনেক বড় হয়ে গেছে। কাজেই, উপসংহারে আসি। সর্বশেষ অধ্যায়ে মুরশিদ সংক্ষেপে বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য বলেছেন এই সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মিতা (পৃ- ৫০২)। কিন্তু কিছুদূর পরে তিনিই আবার উল্লেখ করেছেন শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিয়ের অগ্রহণযোগ্যতা, ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার, আত্মীয়-সম্বোধন ইত্যাদি (পৃ-৫১৬)। তাহলে সমন্বয়ধর্মিতা মানে কি শুধুই পাশাপাশি বাস করা?


সামাজিক বিজ্ঞানে সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে, সেই সাথে আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য যা’ থেকে কোন একটা সংস্কৃতিকে সতন্ত্র্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মুরশিদ শুরু করেছেন এই অনুমান দিয়ে যে, সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তাই তিনি সেদিকে না গিয়ে বলেছেন যে, পাঠের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি কি তা’ পাঠকের উপলব্ধিতে আসবে। কিন্তু তার আলোচনায় স্ববিরোধীতার জন্য সেই উপলব্ধি স্পষ্ট হওয়ার বদলে আরও ঝাপসা হয়ে আসে। তাছাড়া মুরশিদ বইয়ের অধ্যায়গুলোতে সংক্ষিপ্ত উপসংহার যোগ না-করায় একেকটা অধ্যায়ে তিনি কি বক্তব্য উপস্থাপন করলেন তাও বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, সময় সময় মুসলমান শাসকদেরকে অনাবশ্যক স্থানীয় হিন্দুদের উপর বহিরাগত আক্রমণকারী উল্লেখ করাও তার মূল বক্তব্যকে (অর্থ্যাৎ, সমন্বয়ের সংস্কৃতির ধারণা) দূর্বল করে দিয়েছে। তিনি সর্বশেষ অধ্যায়ে যে উপসংহার টেনেছেন, তা হওয়ার কথা পূর্বের সমস্ত অধ্যায়ের একটা সারসংক্ষেপ, কিন্তু সেখানে দেখি অধিকাংশই নতুন আলোচনা যার সাথে পূর্বের অধ্যায়গুলোর কোন সম্পর্কই নেই।


সর্বোপরি, আমার মনে হয়েছে মুরশিদের মধ্যে সংস্কৃতি পাঠের ব্যাপারে একাডেমিক বোঝাপড়ার ঘাটতি আছে, বিশেষ করে কি কি সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একাধিক সংস্কৃতি মিলেমিশে একটা একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সেই সংস্কৃতি কিভাবে সময়ের আবর্তে অন্য সংস্কৃতি থেকে গ্রহন/বর্জন করে, সামাজিক সচলতা কিভাবে সামাজিক শ্রেণীদ্বারা প্রভাবিত হয়, এবং জাতীয়তাবাদের উদ্ভবে শাসক এবং শাসিত শ্রেণীর ভূমিকা কি। বিদ্যমান আলোচনার প্রেক্ষিতে এইসব আবশ্যিক বিষয়ের তত্ত্ব ও কনসেপ্টকে আলোচনায় না নেওয়ার ফলেই সম্ভবতঃ মুরশিদ এই বইয়ে তার বয়ানের স্ববিরোধীতাগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি এবং বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ ও বিকাশের একটা তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।


মোটের উপর, বাঙালি সংস্কৃতিকে জানার ক্ষেত্রে এই বইটাকে আমার কাছে অসম্পূর্ণ এবং অপরিপক্ব মনে হয়েছে। আর তাই বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হিসেবে এই বইকে আমি নির্ভরযোগ্য মনে করি না। কারণ, সার্বিক বিচারে এটি একটা নিছক প্রোপাগান্ডা পুস্তক ছাড়া আর কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। আর এরজন্য অনেকাংশে দায়ী সমাজ গবেষণায় লেখকের দক্ষতার অভাব

2,946 views0 comments
bottom of page