top of page

এই আমি 

mahmud-hasan.jpg

পেশায় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। চাকুরিসূত্রে সপরিবারে থাকছি কাতারের রাজধানী দোহায়। উচ্চতর পড়াশোনার শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে, আর শেষ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (লস এঞ্জেলস)। মাঝে গ্লোবাল স্টাডিজে একটা মাস্টার্স ডিগ্রী করেছি টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে নর্থওয়েষ্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতার ক্যাম্পাসে পড়াই সমাজকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নানান বিষয়। বিশ্বায়ন, উন্নয়ন, অভিবাসন নিয়ে গবেষণায় ব্যাপক আগ্রহ এবং অল্প অভিজ্ঞতা আছে। আর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু বাংলাদেশের সমাজ এবং এর মধ্যকার ব্যক্তি।

পড়াশোনা ও লেখাপড়া

বাবা মা উভয়েই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাবা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হেড মাস্টার, আর মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। নানা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মায়ের ছয় বোনের পাঁচজনই স্কুল শিক্ষক এবং তারা প্রত্যেকেই আমার কাছে মায়ের মত। কারণ, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ছিল নানাবাড়িতে। বাড়িতে পাঠসূচির বাইরের বইয়ের ছিল ছড়াছড়ি। তাই বর্ণ পরিচয়ের পর থেকেই বই-পড়াটা অভ্যাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে দিনে দিনে। ক্লাস সিক্সে একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে বাম পয়ের গিরা মচকে শয্যাশায়ী ছিলাম মাসখানেক। সেসময়েই ছয়খন্ডের শরৎচন্দ্র রচনাবলীর প্রথম পাঠের সমাপ্তি ঘটেছিল। তারও আগের বছর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার আগের দিন ঘরের সিলিঙের উপরে ঘাপটি মেরে বসে সারাদিনে একটানা মাসুদ রানা সিরিজের ‘রিপোর্টার-২’ পড়ার কথাও মনে পড়ে। মনে আছে বগুড়ার রোমেনা আফাজের রচিত দস্যু বনহুর সিরিজের গোটা বিশেক বই, আব্দুল্লাহ আল মুতী, জসীমউদ্দীন, বিপ্রদাস বড়ুয়া, আলী ইমাম, সুকুমার রায়ের ছোটদের সাহিত্যও। সেইসাথে ছিল ময়মনসিংহ আর জামালপুর রেলস্টেশনের বুকস্টল থেকে কেনা দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলি। বাড়িতে আরও আসত সাপ্তাহিক ফুলকুড়ি আর যায়যায়দিন।

 

মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগে থেকেই স্কুলে যাই। ছাত্রছাত্রীদের সাথে খেলাধুলা করতে করতে কখন যে প্রথম দুই ক্লাস পার হয়েছে কেউ বুঝতে পারেনি। পড়ার বই থেকে যা কিছুই জিজ্ঞেস করত, তোতাপাখির মতো গড়গড় করে বলে দিতাম। ফলে সবাই মনে করত পড়াশোনা ভালোই চলছে। কিন্তু ধরা পড়লাম দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে শূন্য পেয়ে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছিল আমার লেখাপড়া। অর্থ্যাৎ, স্কুলের সিলেবাস এবং ক্লাসের গাইডেন্স অনুযায়ী লেখা এবং পড়া। বাড়তি বই পড়ার আগ্রহ আর অভ্যাস ছিল বলেই হয়তো ক্লাসের সমস্ত পড়া ছয়-মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার আগের এক সপ্তাহেই শেষ করা যেতো। ফলে বছরের বাকি দিনগুলো আগের মতোই ক্লাসের বাইরের পড়ার সুযোগ ছিলই। ক্লাস সেভেনে রংপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বছর পুরোটাই সব পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করেছি সিলেবাসের বাইরের পড়ায় বেশি আগ্রহের জন্য। 

লেখাপড়া আর পড়ালেখার এই টানাপোড়েন চলেছে স্কুল এবং কলেজ জীবনের শেষ পর্যন্ত। আমাদের ক্যাডেট কলেজে একটা দারুণ রীতি ছিল- সেভেন আর এইট ক্লাসের সকল ক্যাডেট প্রতি বছর দুইটা করে নতুন বই হাউস লাইব্রেরীতে “উপহার” দিত। কে কোন বই উপহার দিবে, সেইটা আবার এক সিনিয়র ক্যাডেট লিখে দিতেন ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে। ফলে প্রতিবার ছুটি শেষে হাউস লাইব্রেরীগুলো ভরে উঠতো বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের নতুন নতুন সব উপন্যাস আর গল্প দিয়ে। এতে আমার হয়েছিল সোনায় সোহাগা। হুমায়ূন আহমেদের লেখা সবগুলো বইয়ের সাথে সাথে জহির রায়হান, শওকত আলী, তারাশংকর, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবেরসহ সেসময় বাংলাদেশের জনপ্রিয় অধিকাংশ উপন্যাস, আর বিমল কর, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব ও সঞ্জীবের সবগুলো উপন্যাস আর গল্পগ্রন্থ। এর সাথে ছিল বেশ কিছু পত্রিকার ঈদসংখ্যা এবং দেশ পত্রিকার পুজা-সংখ্যা। বন্ধু মামুন এবং আরও কয়েকজনের কাছে ছিল সেবা প্রকাশনীর বই সংগ্রহ, বিশেষ করে সেবা-ওয়েস্টর্ন। সেইসাথে কলেজ লাইব্রেরীতে পেয়েছিলাম দেশ প্রত্রিকার অনেকগুলো বছরের সংগ্রহ এবং মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাবলীর বাংলা অনুবাদ। ক্লাসের টেক্সটের পড়া আগের মতোই চলতো পরীক্ষার আগের কয়েক রাত। বাদবাকি দিনগুলো নিজের পছন্দমত বই পড়া। তবে ১৯৯৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার তিনমাস আগে থেকে সব বাদ দিয়ে কেবলমাত্র টেক্সট বই পড়েছি। দিনে ১২ ঘণ্টা করে। প্রতিদিন। রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে মানবিক বিভাগের মেধা তালিকায় ৫ম স্থান পেয়েছিলাম। আরেকটু উপরে থাকার আশা ছিল বলে খুশি হতে পারিনি। দু’বছর পর ১৯৯৬ সালে এইচএসসি’তে রাজশাহী বোর্ডে মানবিকে মেধা তালিকায় খানিকটা এগিয়ে ২য় স্থান পেলেও ১ম স্থানটি অধরাই রয়ে যায়।

 

১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সমাজবিজ্ঞানে। কলাভবনের আশেপাশে ঘুরঘুর করি সারাদিন, মাঝে মাঝে ক্লাস হয়। লাইব্রেরীতে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসি। কিন্তু চোখ শুধু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে। টিভিতে দেখা কোন অধ্যাপককে দেখলে গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে ওঠে সম্মানে, শ্রদ্ধায়। স্বপ্ন দেখি তাদের মতো করে কবে সমাজকে জানবো, বুঝবো। কোন কোন ক্লাসে নোট লিখি, আর কোনগুলোর জন্য আগের ব্যাচের স্টারদের নোটের ফটোকপি সংগ্রহ করি। স্কুল-কলেজের পরীক্ষার মতো মুখস্থ করে নয়, বরং নিজের মতো করে বুঝে, নিজের মতো করে উত্তর লিখে দিয়ে আসি। এবং ধরা খাই। প্রারম্ভিক সমাজবিজ্ঞান আর বিয়ে ও পরিবারের সমাজবিজ্ঞান কোর্সে ১০০ নম্বরের মধ্যে পাই ৫৫, যেখানে ৬৫+ পাওয়া ছাত্রছাত্রীও ছিল। আমার বছরে ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি-হওয়াদের মধ্যে (এসএসসি আর ইন্টার একত্রে) সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া আমার পক্ষে এই ফলাফল হজম করা সম্ভব ছিলনা। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ক্লাসের টেক্সট আর চোথা মুখস্ত করা শুরু করি। নিজে কি বুঝি তার থেকে প্রাধান্য দেই ক্লাসের শিক্ষক কেমন উত্তর পছন্দ করেন। ফলাফলও পাই হাতে হাতে। প্রথমশ্রেণী তথা ৬০% এর উপরে নম্বর পেতে শুরু করি (দুটো বাদে) সবগুলো কোর্সে। প্রথম শ্রেণীতে ৩য় হয়ে অনার্স শেষ করি। মাস্টার্সে হই প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। বড় কোন পরীক্ষায় প্রথম হতে না-পারার দুঃখটা রয়েই যায়। দুঃখ বলি এই জন্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে প্রথম স্থান পাইনি, সেটা আমার যোগ্যতার অভাবের জন্য নয়। বরং দুজন অধ্যাপক প্রত্যক্ষভাবে আমার খাতার অবমূল্যায়ন করেছিলেন বলে। আল্লাহ্‌ সেই দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন ২০০৫ সালে একইসাথে ফুলব্রাইট আর মনোবুশো দুটো স্কলারশিপ দিয়ে।

 

আমেরিকার ফুলব্রাইট স্কলারশিপ বাদ দিয়ে জাপানে গেলাম মনবুশো স্কলারশিপ নিয়ে। সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল স্টাডিজে মাস্টার্স পড়তে। সেখানে গিয়ে আবার পেলাম “পড়া” এবং  “শোনা”, তথা পড়াশোনার সুযোগ। তিনটা ক্লাসের একেকটার জন্য সপ্তাহে গড়ে ১৫০ পাতার একাডেমিক পড়া, হাজার খানেক শব্দের লেখা, আর প্রফেসরদের সাথে তিন-তিরিকে-নয় ঘণ্টার ক্লাস। আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়কে এই প্রথম বাস্তবে পেলাম বলে মনে হলো। বই পড়া এবং লেকচার শোনার কোন থৈ পাইনা। প্রথম সপ্তাহে এক ক্লাসের পড়া ছিল এডওয়ার্ড সাইদের ওরিয়েন্টালিজম। একটানা পড়ে শেষ করলাম সেই বই। দেড়-দিনে। সুনীল-শীর্ষেন্দু-বুদ্ধদেবের বড় বড় সব বই একটানা পড়ার অভ্যাস থাকলেও জীবনে প্রথমবারের মতো কোন একাডেমিক বই একটানা পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল এটাই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক পুরো বই পড়া চলছে, আজ অব্দি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লস এঞ্জেলসে পিএইচডি করতে গিয়ে এই পড়ার ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত হয়েছে। তবে গল্প-উপন্যাসের বই থেকে একাডেমিক বইয়ের দিকে আমার এই যে ঝুঁকে পড়া, এরজন্য সবথেকে বেশি প্রভাবকের কাজ করেছে আমার একাডেমিক গবেষণা। 

গবেষণা অভিজ্ঞতা 

আমার যাবতীয় গবেষণার লক্ষ্য মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে তার সমাজ কিভাবে নির্ধারণ করে সেটা জানা। এই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল রংপর ক্যাডেট কলেজে। ইতিহাস আমার বরাবরেই প্রিয় বিষয়। ক্লাস ফোরে থাকতেই আমার এক খালার ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসের দুই পার্টের টেক্সট বই পড়ে শেষ করেছিলাম। ক্যাডেট কলেজে গিয়ে মানবিক বিভাগে গিয়েছিলাম ইতিহাস পড়বো বলে। আর হাসান স্যার ছিলেন চোখের সামনে এক জীবন্ত মডেল। অনার্সে তৃতীয় বর্ষে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব ছিল একটা বাধ্যতামূলক ক্লাস। দুইটা সেকেন্ডারি টেক্সট ছিল ক্লাসের জন্য। তবে ক্লাসের নোটের ‘চোথা’ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ঠ ছিল বলে ক্লাসের বোরিং লেকচারে মন ছিলনা। লাইব্রেরীর জার্নাল সেকশনে গিয়ে বিদেশী জার্নাল দেখি, ধূলোর স্তরের নিচ থেকে টেনে বের করি কোন একটা সংখ্যা। উল্টে-পাল্টে দেখি কিছু পাতা। স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে দেখি কঠিন সব ইংরেজি লেখা। কিছু বুঝি না। এমনই একদিন Contemporary Sociology জার্নালের একটা সংখ্যায় একটা ছোট্ট প্রবন্ধের শিরোনামে দেখি লেখা End of Sociological Theory, যার প্রথম বাক্যটার বাংলা অর্থ ছিল “সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব গোল্লায় গেছে”! লেখক ছিলেন Steven Seidman, State University of New York, Albany-তে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। বুয়েটের এক বন্ধুর পরামর্শে তাকে ইমেইলে লিখিলাম যে, সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর এমন দাবীর প্রেক্ষিতে তার কোন গবেষোনা-প্রবন্ধ আছে কিনা। পরের মাসেই আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা বড় প্যাকেট আসল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমার রুমে। এরমধ্যে ছিল Seidman এর সম্পাদনায় প্রকাশিত The Postmodern Turn (1994) বই আর তার নিজের চারটা প্রবন্ধ! সেটা ছিল ২০০৩ সাল। পড়লাম এবং জানলাম পোষ্টমডার্নিজম কি। নানান রকম চিন্তাভাবনা শেষে মাস্টার্সে থিসিস গবেষণার বিষয় হিসেবে স্থির করলাম পরিচয়ের রাজনীতি, আর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে নির্বাচন করলাম ‘গাঞ্জাখোর’ পরিচয়। 

জাপানে মাস্টার্স পড়ার সময় টোকিওর দুটো ‘হালাল শপে’ নিয়মিত যেতাম বাজার করতে আর আড্ডা মারতে। সেখানে বাংলাদেশী অনেক মাইগ্রেন্টের সাথে আলাপ-পরিচয় হয়। তাদেরকে দেখেছি পরিবারের জন্য সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে, বিশেষ করে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে। অথচ ক্লাসের পড়ার মধ্যে দেখলাম বলা হচ্ছে যে, মাইগ্রেন্টরা রেমিট্যান্স পাঠায় মূলতঃ নিজের স্বার্থ বিবেচনায়। এথনোগ্রাফি কোর্সে শেষ করে বাংলাদেশীদের মধ্যে আমার দ্বিতীয় মাস্টার্সের থিসিসের জন্য একটা গবেষণা করলাম যেখানে ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্ব অনুসরণ করে আমি পাঠ করলাম কিভাবে মাইগ্রেন্টরা তাদের নিজ নিজ সামাজিক কাঠামো ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে আত্মত্যাগী থেকে স্বার্থসচেতন হয়ে উঠতে পারে। 

পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা মূল হলেও একাডেমিক পড়া আর লেখাটাই এখানে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লস এঞ্জেলসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ আমেরিকার প্রথম কয়েকটির একটি। এখানে পড়ান সমাজবিজ্ঞানের নানান শাখার কয়েকজন নামকরা অধ্যাপক। ক্লাসে টেবিলের ওপারে প্রায়ই দেখি ক্লাসের শিক্ষকের বদলে সদ্য প্রকাশিত এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত কোন গবেষণা-পুস্তকের লেখককে, তার বইয়ের নানান দিক নিয়ে সমালোচনামূলক আলাপ করি। এইসবের মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে আমার তৃতীয় মাস্টার্স ডিগ্রীটাও হয়ে যায়। ডিসার্টেশনের জন্য পরিকল্পনা করি মাইগ্রেন্টরা কেন রেমিট্যান্স পাঠায় তা’র একটা সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর। গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিই গ্লোবাল এথনোগ্রাফি আর গবেষণা মাঠ হিসেবে টোকিও আর লস এঞ্জেলসের বাংলাদেশী মাইগ্রেন্টদেরকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এই গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করি এবং একইসাথে লেখালেখির চর্চা করি। ২০১৫ সালের জুন মাসে ডিসার্টেশন গৃহীত হলে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করি। একই সময় নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পাই, পোস্টিং কাতার ক্যাম্পাসে।

প্রকাশনা 

আমার প্রথম আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হয় Contemporary Justice Review জার্নালে। এটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স থিসিস থেকে লেখা একটা আর্টিকেল। এরপরের প্রকাশনাটা ছিল সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে করা আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স থিসিস থেকে। আর তৃতীয় প্রকাশনা ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে করা আমার তৃতীয় মাস্টার্স থিসিস থেকে। এরপর অবশ্য অন্যান্য গবেষণা থেকেও প্রকাশনা শুরু হয়। আমার প্রথম গবেষণা-বইয়ের পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ করেছি মাত্র।  নিজের গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপশি আমি সমাজবিজ্ঞান এবং মাইগ্রেশন স্টাডিজের প্রায় ডজনখানেক একাডেমিক জার্নালের রিভিউয়ার এবং একটা জার্নালের সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবে ম্যানুস্ক্রিপ্ট মূল্যায়নে জড়িয়ে আছি।

পড়ানো

আমি বিশ্বায়ন, উন্নয়ন, মাইগ্রেশন, এবং প্রারম্ভিক সমাজবিজ্ঞানের কিছু কোর্স পড়াই অনার্স পর্যায়ে। প্রতিটি ক্লাসের সিলেবাস নিজের পড়াশোনা ও গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করি। প্রতি বছর নতুন নতুন প্রবন্ধ, বই, ডকুমেন্টারি ও বিনোদনমূলক সিনেমা অন্তর্ভুক্ত করি সিলেবাসে। সেমিস্টার শেষে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে গঠনমূলক সমালোচনা ও মূল্যায়ন পাই আমার পড়ানো থেকে তারা কি কি শিখল আর কিভাবে আমি আরও ভালো করে তাদেরকে শেখাতে পারতাম সেসব বিষয়ে। অন্যান্য অধ্যাপকদের সাথে সাপ্তাহিক আড্ডার মধ্য দিয়ে পড়ানো আর গবেষণার নানান বিষয়ে জানাশোনা হয়। ক্লাসে ভালো পড়ানোর জন্য যে তাগিদ থাকে, তার সাথে যুক্ত হয় কলিগদের মধ্যকার একটা অনুচ্চারিত প্রতিযোগিতা। তবে এইটা গঠনমূলক প্রতিযোগিতা- কে কত বেশি ভালো গবেষণা ও প্রকাশনা করতে পারে, কত বেশি আপডেট তথ্য কলিগদের মধ্যে শেয়ার করতে পারে, কত বেশি গবেষণা-ফান্ড জিতে নিয়ে আসতে পারে, কোথায় কোন কনফারেন্স হচ্ছে, ইত্যাদি।

পড়া

পড়ানোর জন্য, নিজের গবেষণার জন্য এবং রিভিউয়ারের ভূমিকার জন্য গবেষণা-বই ও প্রবন্ধ পাঠ চলছে। এর পাশাপাশি আমি আগ্রহী বাংলাদেশের, তথা বাঙ্গাল মুসলমানের ইতিহাস পাঠে। গল্প উপন্যাস এখনো টানে। তবে তারও থেকে বেশি টানে একাডেমিক বা বিশ্লেষণধর্মী লেখা।

bottom of page