top of page
  • Hasan Mahmud

‘বাঙালি মুসলমানের মন’: গোঁজামিলের এক জ্ঞানবৃক্ষ


জাতীয় পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা আছে, আছে তার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ। মোটাদাগে, জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয় জাতিসত্তা (ethnic membership) এবং নাগরিকতার পরিচয়ের (political membership/ citizenship) ভিত্তিতে। জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকতার পরিচয় জাতিসত্তাসহ অন্যান্য পরিচয়গুলোর উপর প্রাধান্য পায় এই বিচারে যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার। কিন্তু এই ধারণা বাস্তবে প্রয়োগ করার সময় দেখা যায় যে, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বংশ পরিচয় ইত্যাদি বর্গের ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তি আবার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা অনুযায়ী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উঁচুনিচু ভেদাভেদ তৈরি করে। এই বিভাজন এবং গোষ্ঠীসমূহের অবস্থান নানান সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ঘটে থাকে বলে তা চিরস্থায়ী নয়, বরং সতত পরিবর্তনশীল। কাজেই উচ্চস্থানে থাকা গোষ্ঠীসমূহ স্বভাবতই নিজ নিজ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। আর তুলনামূলকভাবে নিচু অবস্থানের গোষ্ঠীসমূহ উচ্চ অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করে। অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্রের মধ্যকার সমগ্র জনতা একই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিত এবং স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে নানান বর্গে বিভক্ত এবং দলীয়/গোষ্ঠীগতভাবে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত - ক্ষমতায়, সম্মানে, অধিকারের স্বীকৃতিতে। এই প্রেক্ষিতে আমি আলাপ করতে চাই বাংলাভাষায় প্রবলভাবে জারি-থাকা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বয়ানটি। শিক্ষিত সমাজে জনপ্রিয় এই বয়ানের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানদেরকে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে দাবি করা হয় তাদের অশিক্ষা, পশ্চাদমুখীনতা এবং ধর্মীয় আচার-বিশ্বাসকে। অনুচ্চারে এই দাবির মধ্যে এই অনুমান জারি করা হয় যে, মুসলমান সমাজের সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ার দায় তাদেরই।


১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রে সমগ্র নাগরিক সমাজে বর্তমানে দশজনে প্রায় নয়জনই মুসলমান। এই মুসলমানরা কারা? এই প্রশ্নের উত্তর আছে বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামক বয়ানের মধ্যে। এই বয়ানে জনপ্রিয়তম লেখাটি আহমদ ছফার বহুল পঠিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’[1]। এখানে ছফা লিখেছেন : “এক কথায় এর উত্তর বোধ করি এভাবে দেওয়া যায় : যারা বাঙালি এবং একই সঙ্গে মুসলমান। তারাই বাঙালি মুসলমান।” এদেরকে ছফা চিহ্নিত করেছেনে ইতিহাসের আদি থেকেই ‘নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী’ হিসেবে যারা আর্যদের বর্ণাশ্রম প্রবর্তিত হলে তার অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ ছিলনা (পৃষ্ঠা, ২৭)। পরাজিত এই অন্ত্যজ সমাজ তাই একবার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। এরপর মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা হলে ‘ভীত-সন্ত্রস্ত’ এই বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে।ছফা দাবি করেছেন যে, “বাঙালি মুসলমানেরা শুরু থেকেই তাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিল” (পৃষ্ঠা, ৩০)।


বহুল প্রচলিত এবং স্বীকৃত একটি ধারণা এই যে, সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ। অর্থাৎ, সাহিত্যের বিশ্লেষণের মধ্যে সেই সমাজের একটা চিত্র পাওয়া যায়।কাজেই, পুঁথিসাহিত্যের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজকে বোঝার প্রয়াস পেয়েছেন, তা পদ্ধতিগতভাবে সঠিক। কিন্তু এই পদ্ধতির প্রয়োগে তিনি ছিলেন একেবারেই অপটু। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগে দেখে নেই তাঁর পুঁথিসাহিত্য বিশ্লেষণ বাঙালি মুসলমান সমাজের কেমন চিত্র অঙ্কন করেছে।


বাঙালি মুসলমান সমাজকে ছফা চিহ্নিত করেছেন একটা আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজ বলে যেখানে “যুক্তিবাদিতার চাষ একেবারে হয়নি”। আর সামাজিক লক্ষ্যের ”দ্বিমুখী বা ত্রি-মুখিতার” কারণে এই সমাজে কোনো মনিষী জন্মাতে পারেনি (পৃষ্ঠা, ৩১)। এই মুসলমান সমাজ কেবলমাত্র দুটি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল বলে তিনি দেখেছেন - তিতুমীরের আন্দোলন আর ফরায়েজী আন্দোলন। কিন্তু এগুলো কোনো আধুনিক রাষ্ট্র বা সমাজ দর্শণে অনুপ্রাণিত হয়ে নয়, বরং কেবলমাত্র ধর্মের অনুপ্রেরণায়। ফলে ছফা রাজনৈতিক দিক থেকে এই আন্দোলনগুলোকে প্রগতিশীল মনে করলেও সামাজিক দিক থেকে পশ্চাৎগামী বলে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, বাঙালি মুসলমান সমাজে যাবতীয় আন্দোলন হয় উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা হিন্দু সমাজের উদ্যোগ ও কর্মপ্রয়াসে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। ফলে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, “প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের মনটিতে একটু রঙ লাগলেও কোনো রূপান্তর বা পরিবর্তন হয়নি” (পৃষ্ঠা,৩২)। ছফার বিবেচনায় কয়েক শতাব্দী ধরে এই সমাজ রয়েছে অনড়, স্থবির। কাব্য-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান কোনো ক্ষেত্রেই বাঙালি মুসলমান কোনো অবদান রাখতে পারেনি। তিনি নজরুল ইসলাম এবং জসীমউদ্দিনের কাব্যক্ষেত্রে সাফল্যের উল্লেখ করেও এগুলোকে বাতিল করেছেন “চিন্তার চাইতে আবেগের”আতিশয্যের কারণে। তিনি দাবি করেছেন যে, “বাঙালি মুসলমানব সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করেনা মনের গভীরে” (পৃষ্ঠা,৩২)। এই সমাজকে ছফা ‘এঁচরে পাকা’ শিশুর সাথে তুলনা করেছেন, যে ভাসাভাসা জ্ঞানের কারণে সবকিছুতেই ভাব ধরে যে জানে, কিন্তু অসংগতি ধরা পড়লে ‘গোঁজামিল’ দেয় এবং এই গোঁজামিল দেওয়াকেই কৃতিত্ব বলে মনে করে। সে আদতে চিন্তা করতেই জানেনা।


ছফা বিশ্বাস করেন যে, “সাবালক মন থেকেই উন্নত সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশ সম্ভব”। কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজ সেই সাবালকত্ব অর্জন করেনি। সে নিজের ভালোমন্দ নিরূপণে অক্ষম। অন্যের পরামর্শ ও কথায় চলাই তার নিয়তি। আবার নিজের এই মানসিক পঙ্গুত্বের জন্য সে সব সময়ই অন্য কাউকে দায়ী করে, কিন্তু নিজের অক্ষমতার দিকে নজর দেয় না। তিনি প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এই বলে যে, বাঙালি মুসলমানের মন “এখনো যে আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয়, মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটা ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারেনা”(পৃষ্ঠা, ৩৩)।


আহমদ ছফার বর্ণনায় বাঙালি মুসলমান সমাজের যে বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা পড়ে সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপে বলা যায় :

১। বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে অপুষ্ট, অতএব পরনির্ভরশীল,

২। বাঙালি মুসলমান স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে অক্ষম বিধায় রক্ষণশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল,

৩। বাঙালি মুসলমান নতুন চিন্তাধারাকে গ্রহণ করতে অক্ষম; ফলে উদ্ভাবনের বদলে অতীতকে আঁকড়ে থাকতে সচেষ্ট,

৪। বাঙালি মুসলমান আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের উন্নতির সুবিধাভোগী, কিন্তু সেখানে নিজে কোনোরূপ অবদান রাখতে অক্ষম বিধায় গোঁজামিল দিয়ে সেই অক্ষমতাকে ঢাকার প্রয়াস পায়।

৫। বাঙালি মুসলমানের মন অনিবার্যভাবেই আটকে আছে এক “প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজে” যা অনিবার্যভাবেই হিন্দু-বিদ্বেষী এবং যেখানে যুক্তি, সৃষ্টিশীলতা আর বিজ্ঞানচেতনার প্রবেশ ঘটেনি।

৬। বাঙালি মুসলমান সমাজের এহেন অনড়, অচল আদিম অবস্থার জন্য দায়ী তাদের জাতিসত্তাগত (বাঙালি) বা ধর্মীয় (মুসলমান) পরিচয় নয়, বরং “একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতি”। (তিনি ঐতিহাসিক পদ্ধতি বলতে কি বুঝিয়েছেন, তা কোথাও পরিষ্কার করেননি)।


প্রথমে আমি ব্যাখ্যা করবো কেন বাঙালি মুসলমানের মন বয়ানটি বিভ্রান্তিকর। আর এইক্ষেত্রে আমি আহমদ ছফার প্রবন্ধটিতেই আলোচনা সীমিত রাখবো।


‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটির নির্মোহ পাঠ এর মধ্যে অগণিত অসঙ্গতি খুঁজে পাবে। এই প্রবন্ধের প্রত্যেকটা প্যারাগ্রাফে, এমনকি প্রায় প্রত্যেকটা লাইনে এইসব সীমাবদ্ধতাগুলো জাজ্বল্যমান।

প্রথমত : আহমদ ছফা আলোচ্য প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমান সমাজের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কোথাও উল্লেখ করেননি সেটা কোন সময়ের এবং কোন অঞ্চলের মুসলমান সমাজ। ঐতিহাসিক স্থান ও কালের একমাত্র রেফারেন্স পাই ছফার এই দাবির মধ্যে যে, পুঁথি সাহিত্য রচিত হয়েছিল তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলায় নতুন একটি সমাজের (তথা মুসলমান) জন্ম হলে তার সাথে আগেকার (তথা, হিন্দু) সমাজের আদর্শিক ঘাত-প্রতিঘাতে মুসলমান জনগণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় (পৃষ্ঠা, ১৭-১৮)। বাংলায় তুর্কি মুসলমানদের অভিযান শুরু হয়েছিল ১২০৪ সালে বখতিয়ারের বিজয়ের মধ্য দিয়ে।উত্তরবঙ্গে শুরু হওয়া সেই মুসলমান শাসন পুরো বাংলায় বিস্তার লাভ করেছিল আরো প্রায় চারশ বছরব্যাপী। অর্থাৎ, ছফার ধারণাকে সঠিক মনে করলে পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব তের শতকের শুরুতে হয়েছিল এই অনুমান গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে এই অনুমানও গ্রহণ করতে হবে যে, ছফা সমগ্র বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়েই আলাপ করছেন, আর সেই সমাজ তেরশতক থেকে অদ্যাবধি একই রকম - অনড়, অবিচল, প্রাচীন। বাস্তবে এমন দাবি অনৈতিহাসিক এবং যেকোনো বিচারেরই অযৌক্তিক, অতএব অগ্রহণযোগ্য।


দ্বিতীয়ত : ছফার প্রস্তাবনা অনুযায়ী পুঁথিলেখকরা যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই হিন্দু দেবদেবীদের প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, বাঙালি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই দেবদেবী পূজারিদের হাতে অত্যাচারিত এবং ঘৃণিত ছিল এবং সেই দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই প্রথমে বৌদ্ধ ও পরে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। রাজশক্তি হিসেবে বাংলায় ইসলামের প্রতিষ্ঠা হলে এই শ্রেণির মধ্যে পুঁথিসাহিত্যের কদর দেখা যায় (পৃষ্ঠা, ১৮-১৯)। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার এই অনুমান সঠিক হলে তো ভারতবর্ষের কোথাও নিম্নবর্ণের হিন্দু থাকার কথা নয়। আফগান আর মুঘল শাসনাধীন ভারতবর্ষে প্রায় এক হাজার বছরে তাদের সকলেরই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে এমনটি কোথাও ঘটেছে বলে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।


তৃতীয়ত : বাঙালি মুসলমান সমাজের স্বরূপ বিশ্লেষণে ছফা প্রচলিত ইতিহাস গবেষণা পদ্ধতি অনুসারে আলোচ্য জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক অবস্থান এবং ঐতিহাসিক কাল কোনো কিছুরই ধার ধারেননি। উপরন্তু, তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে প্রচলিত জোরপূর্বক এবং সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যেধর্মান্তরের তত্ত্বকে গ্রহণ করেছেন যা ঐতিহাসিক এবং যৌক্তিকভাবে সম্পূর্ণ ভুল।


যেকোনো একাডেমিক গবেষণায় পদ্ধতিগত বা তত্ত্বীয় সীমাবদ্ধতা থাকলে তা সেই গবেষণার ফলাফল এবং তার উপর ভিত্তি করে নেওয়া সিদ্ধান্তকে অনিবার্যভাবেই ভুল পথে ধাবিত করে। আলোচ্য প্রবন্ধে এই দুই ধরনের সীমাবদ্ধতাই বিদ্যমান। ফলশ্রুতিতে, ছফার বিশ্লেষণও অগ্রহণযোগ্য এবং সেখান থেকে প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তগুলো বিভ্রান্তিকর। কয়েকটা উদাহরণ দিলে এগুলো স্পষ্ট হবে। ছফা দাবি করেছেন যে, দোভাষী পুঁথির রচয়িতারা ছিলেন আরবি-ফার্সী ভাষাজ্ঞানহীন, অশিক্ষিত এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনায় অপারগ। তুলনামূলক অগ্রসর হিন্দু সমাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব এবং ঘৃণাবোধ থেকেই তারা বানিয়ে বানিয়ে পুঁথি সাহিত্যে নানান কাহিনি ফেঁদেছেন যেখানে হিন্দুদেরকে একহাত দেখে নেওয়া গেছে। এই পর্যবেক্ষণ সত্য হলে একথাও তো মানতে হয় যে, মুসলিম রাজসভায় বসে যেইসব শিক্ষিত এবং উচ্চশ্রেণির মুসলিম সাহিত্যিকরা (এমনকি কতিপয় হিন্দু সাহিত্যিকও) উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের দ্বারা একইভাবে অত্যাচারিত ছিলেন এবং ফলশ্রুতিতে তাদের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। কারণ, তাদের বর্ণিত কাহিনি আর পুঁথিসাহিত্যের কাহিনি একই রকম।রাজক্ষমতার আশ্রয়ে থেকেও হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত হওয়া এবং তার ফলে হিন্দু বিদ্বেষী হওয়ার অনুমানটা সহজপাচ্য নয়। উপরন্তু হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মের সাহিত্যকদের রচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সমন্বয়ধর্মী সাহিত্যকর্মগুলোর অস্তিত্ব এবং জনপ্রিয়তাও ছফার অনুমিত শতাব্দিব্যাপী হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক হানাহানির দাবিকে ভুল প্রমাণ করে।


ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজে কোনো রকম প্রগতিশীলতা খুঁজে পাননি যার সমর্থনে উল্লেখ করেছেন যে, শিল্পে-সাহিত্যে বা সমাজের প্রগতির পথে বাঙালি মুসলমানের কোনো অবদান নেই। তিনি অন্যতম প্রধান বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম এবং জসীমউদ্দিনের সাহিত্যকর্মকে আবেগের আতিশয্যের কারণে বাতিল গণ্য করেছেন। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব তিনি চিহ্নিত করেছেন এই দাবির মধ্যে যে, তারা কোনোপ্রকার উন্নত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন করেনি। তার মতে তিতুমীরের আন্দোলন আর ফরায়েজী আন্দোলন ছিল নিছক ধর্মীয় আন্দোলন। বাস্তবে এই দুটি ধারণাই ভ্রান্ত - নজরুল আর জসীমউদ্দীনের সাহিত্যিক অবদান প্রশ্নাতীত। আর তিতুমীরের আন্দোলন এবং ফরায়েজী আন্দোলন দুইটিই আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক লক্ষ্যে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক আন্দোলন বলে ইতিহাস গবেষকরা একমত[2]


এই প্রবন্ধের সবথেকে গুরুতর বিষয় ছফার হাতে তথ্যের অবাধ বিকৃতি এবং অপব্যাখ্যা। তিনি মীর মশাররফ হোসেনের বিখ্যাত রচনা বিষাদসিন্ধুর মধ্যে ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথিতে বর্ণিত ব্রাহ্মণ আজরকে “একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই স্থানে” দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন (পৃষ্ঠা,২১)। অথচ, এই দাবি সঠিক নয়, ছফার কল্পিত। বিষাদ সিন্ধুর আজর হিন্দু নয়, ব্রাহ্মণ তো নয়ই। হোসেনের কাঁটা মস্তকের সামনে সে এবং তার পরিবার ইসলাম গ্রহণও করেনি। এমনকি হোসেনের খণ্ডিত মস্তকও কোনো অলৌকিক কাণ্ডই ঘটায়নি। মীর মশাররফ হোসেন আজরের যে বর্ণনাটি দেন এভাবে :

“গৃহ-স্বামী বাস্তবিক হয়রত মুহাম্মদ মোস্তফার শিষ্য ছিলেন না। নানা প্রকার দেবদেবীর আরাধনাতেই সর্ব্বদা তিনি রত থাকিতেন। তার উপযুক্ত তিন পুত্র ও এক স্ত্রী বর্ত্তমান। গৃহস্বামীর নাম ‘আজর’[3]


যে কেউ বিষাদ সিন্ধু বই পড়লে দেখবেন যে, হোসেনের প্রতি আজর এবং তার স্ত্রীর সহমর্মিতা ধর্মের জন্য নয়, বরং উদারনৈতিকতা, মানবিকতাবোধ থেকে উৎসারিত। আর এগুলো সবই আধুনিকতাপ্রসূত মানব বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকৃত[4]। অর্থাৎ, বিষাদ সিন্ধু পাঠে আমরা ছফার প্রস্তাবিত দাবির বিপরীতে গিয়ে বরং মুসলমান সাহিত্যকদের মধ্যেও আধুনিক ধ্যান-ধারণার খোঁজ পাই। এ থেকে প্রশ্ন জাগে যে, ছফার মতো একজন সামর্থ্যবান সাহিত্যিকও কেন বিষাদ সিন্ধুর ভুলপাঠ করলেন? আর এত গুরুতর একটা ভুলপাঠ কারও নজরে আসলো না কেন? কেনই বা এমন মাত্রাছাড়া ভুলে ভরা একটি প্রবন্ধ শিক্ষিত মহলে এত সমাদৃত হলো?


প্রকৃতপক্ষে, এই প্রবন্ধে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে নতুন কোনো বিষয়ের অবতারণা করেননি। বরং, এর মধ্য দিয়ে তিনি শিক্ষিত মহলে বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে প্রচলিত কতিপয় নেতিবাচক পূর্বধারণারই (stereotype) পুনরাবৃত্তি করেছেন।


আহমদ ছফার এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। যেমন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, সলিমুল্লাহ খান সহ[5] আরো অনেকে এই প্রবন্ধকে গত শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ দশটি রচনার একটি মনে করেন। সত্তর দশকের শেষভাগে রচিত এই প্রবন্ধ আজও বাঙালি মুসলমান বিষয়ক আলোচনাকে প্রভাবিত করে। যেমন, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবরে যুবায়ের আহমদ ‘বাঙালি মুসলমানের মন কি বদলেছে?’[6] শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন যেখানে তিনি আহমদ ছফার বর্ণিত বাঙালি মুসলমান সমাজকে এখনো একই রকম অবস্থায় খুঁজে পান, যারা নিজেদের ভালোমন্ধ নিরূপণে অক্ষম এবং সেজন্য একটা উন্নত রাষ্ট্র নির্মাণে ব্যর্থ। একইভাবে ঢাকার হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১ জুলাই ৭১ টিভি একটি টক-শো সম্প্রচার করে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শিরোনামে যেখানে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বাঙালি মুসলমানের ব্যর্থতা এবং ছফার বর্ণিত সমস্যাকে কারণ হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়।


কেবল গণমাধ্যমেই নয়, একাডেমিক গবেষণা এবং প্রকাশনাতেও এই প্রবন্ধকে তথ্যসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যেমন, ২০১৮ সালে Journal of African and Asian Studies পত্রিকায় ‘Triangular Confluence: Islam and Modernity in Bangladesh’[7] নামের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বাঙালি মুসলমান সমাজের রক্ষণশীলতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ছফার ব্যাখ্যাকে অন্যতম মূলসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে সরদার আবদুস সাত্তার তার ‘বাঙালি মুসলমানের মানসদর্পণ’[8] প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ছফার বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধটি বাঙালি মুসলমান কারা, আর তাদের মনের রূপায়ন কোন কোন সমাজ-সাংস্কৃতিক অভিঘাতে গড়ে উঠেছে, সেক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান একত্রে বাঙালি আর মুসলমান হওয়ার জন্যে যে সংকট অনুভব করে, তারই একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ঐতিহাসিক পটভূমির আলোচনা। অর্থাৎ, আহমদ ছফার এই প্রবন্ধ গণমাধ্যমে এবং একাডেমিক গবেষণায়ও বাঙালি মুসলমান বিষয়ক জ্ঞানের আকর হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং স্বীকৃত।


আহমদ ছফা আলোচ্য প্রবন্ধটি একটা বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন বলে সলিমুল্লাহ খান এবং মোহাম্মদ আজম উল্লেখ করেছেন। সে মতে, একদিন ছফা দেখলেন সেসময়কার প্রখ্যাত স্বঘোষিত নাস্তিক আবুল ফজল পাঞ্জাবি-টুপি পরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। এই দেখে ছফা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। এরই প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখে ফেলেন ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নামের এই বিখ্যাত প্রবন্ধটি। নাস্তিক আবুল ফজলের ইসলাম-ঘেঁষা পরিবর্তন দেখে তিনি ছিলেন বিস্মিত, হতাশ এবং প্রবলভাবে আলোড়িত। ফারুক ওয়াসিফ[9] একটি আলোচনায় উল্লেখ করেছেন যে, আহমদ ছফা আলোচ্য প্রবন্ধটি রচনাকালে একটা ট্রমা বা মানসিক আঘাতের মধ্যে ছিলেন। এহেন মনের অবস্থায় নির্মোহ বিচারের সক্ষমতা ক’জনেরই বা থাকে? উপরন্তু ছফা ঐতিহাসিক নন, সমাজ গবেষণার তত্ত্ব বা পদ্ধতির উচ্চতর প্রশিক্ষণও পাননি। ফলে ছফার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তার প্রবন্ধে উপরে উল্লিখিত তথ্যগত ও পদ্ধতিগত সীমবাদ্ধতাগুলোকে হালকাভাবে নেওয়া যায়ই।


কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন স্বঘোষিত নাস্তিক সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য আগের অবস্থান বদলে ইসলামপন্থী ধারায় ফিরে গেলে আহমদ ছফার মনঃপীড়া হবে কেন? এর একটা কারণ খুব সম্ভবত এই যে, ছফা দেখেছেন রাষ্ট্রক্ষমতার আশ্রয়ে গিয়ে সুবিধা পাওয়ার জন্য আবুল ফজল তার আগের বুদ্ধিবৃত্তিক (নাস্তিকতা, তথা সেক্যুলার) অবস্থান ত্যাগ করেছেন যা আবহমান কালের বাঙালি মুসলমান সমাজেরই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে ছফা বিশ্বাস করেন। যেমনটি তিনি লিখেছেন যে, বাঙালি মুসলমান আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের উন্নতির সুবিধাভোগে অগ্রগণ্য, অথচ সেখানে তার কোনো অবদান নেই। আবার সেই অক্ষমতাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা না করে তারা বরং গোঁজামিল দিয়ে সেটা ঢাকার প্রয়াস পায়। একজন আবুল ফজলকে দেখে আহমদ ছফা সমগ্র বাঙালি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এহেন নেতিবাচক প্রবন্ধ রচনা করাটা আসলে বাঙালি মুসলমান সমাজকে নিয়ে তার মানসপটে থাকা নেতিবাচক পূর্বধারণাগুলোরই (stereotype)বহিঃপ্রকাশমাত্র। যেহেতু তিনি জানতেন যে বাঙালি মুসলমান এরকমই, অতএব তথ্য, তত্ত্ব ও পদ্ধতির যাবতীয় নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ছফা তার উপসংহারে এসেছেন।


কারবালার যে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে ছফা দোভাষী পুঁথি লেখকদের বরাতে সেসময়কার বাঙালি মুসলমান সমাজের চরিত্রকে অশিক্ষিত, সংস্কৃতিবিমুখ এবং নাবালক বলে চিত্রিত করেছেন, সেই একই ঘটনা হুবহু আরো আধ-ডজন মুসলমান সাহিত্যিক এবং একজন হিন্দু সাহিত্যিক পুঁথি সাহিত্যের জন্মেরও কয়েক শতক আগে লিখেছেন এবং সমাজে সেগুলো বহুল প্রচলিতও ছিল। সেইসব সাহিত্যিকদের শিক্ষা, সংস্কৃতিবোধ সবকিছুকেই ছফা এড়িয়ে গেছেন বাঙালি মুসলমানের সম্পর্কে তার নেতিবাচক পূর্বধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য (stereotype)। এই করতে গিয়ে ছফা ১৩ শতক থেকে অদ্যাবধি সাত শতাব্দিব্যাপী বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসকে একাকার, অনড়, অচল বলে সাব্যস্ত করেছেন, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের ইতিহাস এবং সাহিত্যকে অগ্রাহ্য করছেন, এমনকি কবি আব্দুল হাকিমকেও ধরে নিয়েছেন আরবি-ফার্সী না-জানা কবি হিসেবে, যা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। প্রকৃতপক্ষে, ছফা মধ্যযুগের কয়েকশ বছরের মুসলিম সাহিত্যিকদের সমস্ত রচনাকে এককথায় দোভাষী পুঁথির মধ্যে একাকার করে উপস্থাপন করেছেন। বাস্তবে মুসলিম সাহিত্যিক এবং তাদের রচিত সাহিত্যের মধ্যে স্থান (রাজসভা, নগর, গ্রাম) এবং কাল (রাজ বংশ, তুলনামূলক সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ইত্যাদি) ভেদে বিভিন্ন মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এমনকি দোভাষী সেই পুঁথি সাহিত্যই আঠারো শতকের মধ্যভাগে আবির্ভাবের সময় যেমন ছিল, পরবর্তী একশ বছরের পরিক্রমায় বিবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্ণময় বিচিত্র চরিত্র ধারণ করেছে[10]। অর্থাৎ, ছফার বর্ণিত দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের একাট্টা রূপটি বাস্তব নয়, এটা মূলত ছিল ছফার কল্পনায়।


প্রকৃতপক্ষে, ছফার জবানে বাঙালি মুসলমানের যে বয়ান পাই তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী লেখকদের (যেমন, বঙ্কিমচন্দ্র, যদুনাথ, রমেশচন্দ্র প্রমুখ) হাতে বলে ঐতিহাসিক এবং সাহিত্য সমালোচকরা একমত[11]। হিন্দুত্ববাদী এই বয়ানের সারকথা হলো - বাঙালি মুসলমান আদতে নিচুজাতের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত, গ্রাম্য, খ্যাত, অতীতের কুসংস্কার আঁকড়ে থাকা একটা পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যার প্রধান কাজ হলো মধ্যযুগের ইসলামে আশ্রয় নিয়ে আধুনিক শিক্ষায় আলোকিত হিন্দু বাঙালির বিরোধিতা করা। অথচ সেইসব হিন্দুর অধীনতার মাধ্যমেই যে তারাও আধুনিক হয়ে উঠবে, প্রগতির পথে চলবে, কুসংস্কার থেকে মুক্তি অর্জন করবে এই সত্য না-বোঝার মতো মূর্খ, বেআক্কেল। দাড়ি-টুপি আর হিজাবের প্রতি প্রগতিশীলদের যে ঘৃণা, মাদ্রাসার ছাত্রাছাত্রীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকুরির বাজারে যে বৈষম্য, এসবের মূলেও এই একই বয়ান যে, বাঙালি মুসলমান অতীতমুখী, আধুনিকতা-বিরোধী, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিমুখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু তথা সাম্প্রদায়িক। বাংলা-বিভাগের (এমনকি ভারত বিভাগেরও) দায়ও এজন্যই বাঙালি মুসলমানের। স্বদেশী আন্দোলন (অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলন) এজন্যই প্রগতিশীলতার অভিমুখী আন্দোলন যার মধ্যে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক জাতীয় বীর ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন আর প্রীতিলতা।


অথচ, বাঙালি মুসলমানেরও বয়ান আছে নিজেদেরকে নিয়ে, রাজনৈতিক অভিলাষ এবং মুক্তি-অর্জনের সংগ্রামী ইতিহাস আছে, জাতীয় নেতা ও বীর আছে, আছে তাদের বীরত্বগাথা। চলমান হিন্দুত্ববাদী এই 'বাঙালি মুসলমানের মন' বিষয়ক বয়ান সেসবকে আড়াল করে হিন্দুত্বকে চালিয়ে দেয় বাঙালির প্রকৃত জাতীয় পরিচয় হিসেবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে রবীন্দ্র আরাধনা ইত্যাদিকে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাদী চর্চা বলে গ্রহণ করে, আর একই সাথে ইসলাম থেকে নেওয়া স্বাতন্ত্র্যবাদী যেকোনো চিহ্নকে অভিহিত করে বৈদেশিক, অতএব পরিত্যাজ্য বলে।


প্রকৃতপক্ষে, বাঙালি মুসলমান সমাজ যে “অনগ্রসর, প্রগতিবিমুখ, রক্ষণশীল এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন এবং তা আদায়ে অপারগ” এই ধারণাটা ছফা আত্মস্থ করেছিলেন তার সমসাময়িক বাঙালি শিক্ষিত সমাজ থেকেই। একটা স্বতঃসিদ্ধ (axiom) পূর্বানুমান হিসেবে এটি আজও প্রবলভাবেই উপস্থিত। এজন্যই গবেষক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিমান অনেকেই আহমদ ছফার প্রবন্ধের এতসব তথ্য বিকৃতি এবং অপব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে একে শতাব্দীর অন্যতম সেরা প্রবন্ধ বলে অভিহিত করেন। এই প্রবন্ধের পাঠকরাও একইভাবে বিনাবাক্যে ছফার চিত্রিত বাঙালি মুসলমান সমাজকে সঠিক বলে গ্রহণ করে। ব্যাপারটা এমন অবস্থায় চলে গেছে যে, বাঙালি মুসলমান সমাজ যে এইরূপ তা তো সবাই জানে। নানান রকম গোঁজামিল দিয়ে এইসব - ছফারই ভাষায় ‘এঁচরে পাকা’ - গবেষণা বাংলাদেশে এখনো প্রবন্ধ বা বই আকারে প্রকাশ হয়, বুদ্ধিজীবী মহলে এবং পাঠকের কাছে সমাদৃতও হয়, এমনকি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃতও হয়। কয়েকটা উদাহরণ দিলে এই বিষয়টা আরো সহজে বোঝা যাবে।


প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত ড. গোলাম মুরশিদ যে বইটার জন্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস চর্চায় ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, তা হলো ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’[12] (২০০৫)। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধ, সংবাদপত্র, নাটক, লোককথা, স্থাপত্যকলা প্রভৃতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু আগে থেকেই মুসলমান সমাজ সম্পর্কে তার নেতিবাচক ধারণাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সমগ্র বইতে তিনি তথ্যের অপব্যাখ্যা এবং নানারকম জোড়াতালি দিয়েছেন। যেমন, বাংলায় মুসলিম সমাজের উদ্ভবের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে গোলাম মুরশিদ দেখেছেন যে, মুসলিম সুলতানরা রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও “সত্যিকার অর্থে দেশ চলতে থাকে পুরনো হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনে” (পৃ-২৭)। আরও উল্লেখ করেছেন যে, সেসব মুসলিমরা “নিজেদের অবস্থা ফেরানোর জন্যই সুদূর বঙ্গদেশ পর্যন্ত এসেছিলেন। ধর্মপ্রচার করে পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য তারা কেউ এদেশে আসেননি” (পৃ-২৯)। কিন্তু দুই পৃষ্ঠা পরেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে বাংলায় “মুসলিম শাসনের প্রথম শতাব্দীর ইতিহাস তরবারি দিয়ে দেশ শাসনের ইতিহাস” এবং এরপর জাফর খান কর্তৃক ত্রিবেণীতে মন্দিরের পাথর দিয়ে মসজিদ ও মাজার তৈরিকে উল্লেখ করেছেন “তরবারী দিয়ে ধর্ম প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য নজির” হিসেবে (পৃ-২৯)। তার এই দুটো অনুমান পারস্পরিক সাংঘর্ষিক : হয় বাংলা হিন্দু রাজাদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল, নতুবা তরবারি হাতে উদ্যত মুসলমান বিজেতাদের পদতলে ছিল যারা শাসনকার্যের পাশাপাশি ইসলামও প্রচার করতো।যেসব তথ্য তিনি উল্লেখ করেছেন, জাফর খানের ঘটনাটি বাদে আর সবগুলোই আবার প্রথম দাবি, তথা দেশ হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল এই অনুমানকে সমর্থন করে। যেমন, পরের প্যারাতেই তিনি আবার উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমান শাসকদের নামে স্থানীয় (হিন্দু) রাজা ও জমিদারেরাই দেশ শাসন করতেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে এই স্থানীয় হিন্দু রাজাদের ভূমিকা আগের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে (পৃ-৩৭)। এমনকি তরবারি দিয়ে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করার অনুমানে তিনি নিজেই সংশয় প্রকাশ করেছেন (পৃ-৬৪)। অর্থাৎ, বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাস পাঠে মুরশিদের অবস্থান একেকবার একেক দিকে, যা তার তত্ত্বীয় এবং পদ্ধতিগত জ্ঞানের ঘাটতিকে প্রকটভাবে দৃশ্যমান করে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তার বিশ্লেষণ নতুন জ্ঞান হিসেবে বাঙালি শিক্ষিত সমাজে গৃহীত এবং পুরস্কৃত হয়েছে।


না হয় আহমদ ছফা বা গোলাম মুরশিদের ইতিহাস গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা চর্চা ছিলনা বলে তদের প্রবন্ধ ও বই বিস্তর ভুলে ভরা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তত্ত্বজ্ঞানে পারঙ্গম, আর গবেষক হিসেবে সুখ্যাত পণ্ডিতরাই বা কেন একই রকম গোঁজামিল দেওয়া গবেষণা ও প্রকাশনা করেন বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইটির কথা[13]।এই বইতে তিনি ইংরেজ শাসনকালে ১৭৫৭ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনাবলী বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারার হদিস দিয়েছেন। পুঁথিসাহিত্য বা মিশ্রভাষার সাহিত্যের আলাপ দিয়ে এই নিবন্ধের শুরু বলে সেখান থেকেই আনিসুজ্জামানের আলোচনাটা নিয়ে আসি।


আনিসুজ্জামান দেখিয়েছেন যে, মিশ্র ভাষারীতির সাহিত্যের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট ছিল বাংলায় নবাবী আমলের পতন আর ইংরেজ আমলের শুরুর যুগসন্ধিক্ষণ, অর্থাৎ ১৮ শতকের মধ্যভাগে। তিনি সেসময়ে সমাজে লৌকিক হিন্দু ধর্মের সাথে ইসলামের সংঘাতের ফলে মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে ‘নিজধর্মের শক্তির কাছে বহিঃশক্তির তুচ্ছতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্য’ লক্ষ্য করেছেন (পৃষ্ঠা, ১৪৪)। এইসব মুসলমান কবির কল্পনাকে তিনি সাহিত্যগুণ হিসেবে বিবেচনা করতে অস্বীকার করেছেন এই বলে যে, “এই কল্পনার পেছনে তো সুস্থ ও শিক্ষিত মনের অনুভূতি নেই - আছে অন্ধ সংস্কার আর ভ্রান্ত বিশ্বাস” (পৃষ্ঠা, ১৪৪)। তিনি মনে করেন কাব্যশক্তির দৈন্যের কারণে এই সাহিত্য মঙ্গলকাব্য ও লোকগীতিকার ন্যায় সার্বজনীন হতে পারেনি। এই সাহিত্যের সার্বজনীন হতে না-পারার কারণ হিসেবে লেখক আরও উল্লেখ করেছেন এতে মানবরসের (human interest) অভাব এবং কবিদের মধ্যে রচনাভঙ্গির দৈন্য। মোটের উপর, এই ধারার সাহিত্যকে লেখক ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতিধারার নিদর্শন বলে গণ্য করেছেন (পৃষ্ঠা, ১৪৬)। লেখক এই সাহিত্যের আলোচনা শেষ করেছেন এই মূল্যায়ন দিয়ে যে, ইংরেজ শাসনামলের প্রথম একশ বছর মুসলমান সমাজের জন্য এক অবসাদের সময়, যার প্রভাবে মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে জীবনবোধ ও সমকালীন সমাজবোধ “কৃত্রিমতা, গতানুগতিকতা ও ইহজীবন-বিমুখতার বালুরাশিতে হারিয়ে গেছে।” (পৃষ্ঠা, ১৫২)


উনিশ শতকের শেষভাগে এসে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যকার নবজাগরণের অনুরূপ এক ধরনের প্রগতির সূচনা আনিসুজ্জামান খুঁজে পান উচ্চ শিক্ষিত মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে। তবে সেটা গ্রামীণ সমাজকে স্পর্শ করেনি বলে তিনি দাবি করেছেন। উপরন্তু, তিনি উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষিত সেই মুসলমান সাহিত্যিকরাও উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ক্রমবর্ধমান হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে আধুনিক ধ্যানধারণা ত্যাগ করে আবার সাম্প্রদায়িকতা ও রক্ষণশীলতায় ফিরে গেছেন। যেমন, মীর মশাররফ হোসেনের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ‘বিষাদ সিন্ধু’কে আনিসুজ্জামান ধর্মনিরপেক্ষ মানবীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, জীবনের শেষভাগে এসে মশাররফ হোসেন এই ধর্মনিরপেক্ষতা ও হিন্দু-মুসলমান মিলনের চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়ে এক ‘উগ্র স্বাতন্ত্র্যপন্থী মুসলমানে’ পরিণত হয়েছেন যা ‘গাজি মিয়াঁর বস্তানী’ রচনায় প্রকাশিত হয়েছে (পৃষ্ঠা, ১৯৮)। এই চিন্তাগত পরিবর্তনকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মশাররফ হোসেনের মধ্যে ‘ধর্মচর্চা নয়, ধর্মীয় আবেগের সস্তা ও জনপ্রিয় রূপায়ণ’ হিসেবে (পৃষ্ঠা, ২০১)। এই ‘শোচনীয়’পরিবর্তনের একটা অন্যতম লক্ষণ হিসেবে লেখক মশাররফ হোসেনের রচনার মধ্যে ‘হিন্দু সমাজ সম্পর্কে প্রবল বিতৃষ্ণা’র উল্লেখ করেছেন। তবে লেখক আরও উল্লেখ করেছেন যে, হিন্দু সমাজের পুনর্জাগরণের মধ্যে যে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ-স্মৃতির চর্চা ছিল, সেটাও মশাররফ হোসেনের চিন্তাধারার পরিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে (পৃষ্ঠা, ২০৬)। হিন্দু পুনর্জাগরণের এই নেতিবাচকতার জন্য মুসলিম মানসে হিন্দুর শুভবুদ্ধির সম্পর্কে একটা সন্দেহ এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের জন্ম নিয়েছিল বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। এর ফলে মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে সাম্প্রদায়িক মিলন কামনা আর কিছুতেই সমাজে ও সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।


আনিসুজ্জামান আরেকজন সমসাময়িক মুসলমান সাহিত্যিক কায়কোবাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম মিলনের কামনা দেখে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু একইসাথে কায়কোবাদের সাহিত্যে ইরান-আরবের দিকে দৃষ্টিপাত করাকে তিনি মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে উৎসারিত বলে চিহ্নিত করেছেন, যাকে তিনি কায়কোবাদের সাহিত্যগুণের দুর্বলতা হিসেবে দাবি করেছেন। মোজাম্মেল হক, নওসের আলী খান ইউসফজি ও আব্দুল হামিদের রচনার মধ্যেও হিন্দু-মুসলিম মিলনের বদলে ক্রমশ মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্যবাদ প্রাধান্য পেয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করছেন। মোটের উপর, মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনাসমূহের সাহিত্যগুণ বিশ্লেষণে আনিসুজ্জামান যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর সেই বিশ্লেষণ থেকে মুসলমান সমাজের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন সেখানে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :

১। মুসলমান সাহিত্যিকরা সমসাময়িক হিন্দু সাহিত্যিকদের তুলনায় ইতিহাসবিমুখ এবং সামাজিক পরিবর্তনকে ধারণ করতে অক্ষম এবং অনিচ্ছুক।

২। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হিন্দু সাহিত্যিকরা মধ্যযুগীয় সাহিত্য থেকে (অতিপ্রাকৃত, কল্পকাহিনি, ধর্মীয় কাহিনি ইত্যাদি) সরে গিয়ে সমাজের দৈনন্দিন জীবন ও বাস্তবতাকে উপজীব্য করে সাহিত্যসাধনায় ব্রতী হয়েছে, তথা প্রগতির পথে হেঁটেছে। কিন্তু মুসলমান সাহিত্যিকরা হিন্দুদের প্রতি উগ্র সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষবশত তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার নিমিত্তে অতীত কালে, এমনকি বাংলার বাইরে ইরান-আরবের সমাজের কল্পকাহিনিতে ফিরে গেছে।

৩। মুসলমান সাহিত্যকরা কখনো কখনো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেও শেষ বিচারে তারা অনিবার্যভাবেই হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন থেকেছে।


উপরে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে আনিসুজ্জামানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে হিন্দুদের প্রতি সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্যণীয়। সাহিত্যের বিচারের মধ্য দিয়ে যদি লেখকের চিন্তাধারার অনুসন্ধান করাই লক্ষ্য হয় (পৃষ্ঠা, ২৬), তবে সমসাময়িক সমাজের সমগ্র চিত্রই বিবেচনা হতে হবে, যা আনিসুজ্জামানের বিশ্লেষণে অনুপস্থিত। তিনি গাজী মিয়াঁর বস্তানী রচনার মধ্যে মশাররফ হোসেনের ‘উগ্র স্বাতন্ত্র্যপন্থী মুসলমান’ হিসেবে রূপান্তরের শুরু লক্ষ্য করেছেন (পৃষ্ঠা, ১৯৮)। এর মধ্যে যে সমাজ সমালোচনা আছে, তা নিরপেক্ষ নয় বলেও তিনি মত দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই রচনাটির মধ্যে ২৪ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্রের রচিত কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫) রচনার প্রেরণা ছিল। কিন্তু আনিসুজ্জামান বঙ্কিমের ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত আর সব রচনার মধ্যে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছেন। একইভাবে তিনি সেই সময়ে অন্যান্য হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং শিক্ষিত হিন্দু সমাজে চলমান উগ্র এবং সহিংস হিন্দু জাতীয়তাবাদি (যা স্বদেশী নামে পরিচিত) আন্দোলনকেও বেমালুম পাশ কাটিয়ে গেছেন, যেগুলো অনিবার্যভাবেই মশাররফ হোসেনের মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে হাজির ছিল। আনিসুজ্জামান বিদ্যাসাগরের রচনার মধ্যে “পৌরুষ” দেখেন, বঙ্কিমের “কবিপ্রতিভা” দেখেন (পৃষ্ঠা, ১৮৪), কিন্তু এদের কারো মধ্যেই ক্রমবর্ধমানব উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং সেই সাথে মুসলমান-বিদ্বেষ দেখেন না। আবার এদের সাথে তুলনা করেই মুসলমান সাহিত্যিকদেরকে সাব্যস্ত করেন সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎমুখী, প্রগতিবিরোধী বলে।


আহমদ ছফার স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রবন্ধের সারাংশের সাথে আনিসুজ্জামানের বইতে উল্লিখিত বাঙালি মুসলমান সমাজের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো মিলিয়ে পড়লে সহজেই অনুমান করা যায় আহমদ ছফা কোথা থেকে বাঙালি মুসলমান সমাজ সম্পর্কে তার নেতিবাচক পূর্বানুমানগুলো (stereotype) পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বাংলা সাহিত্যের চর্চার মধ্যেই বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে প্রচলিত stereotype-গুলো ছিল। এর বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনুরূপ stereotype-এর প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমরের রচিত ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য। এই প্রবন্ধে তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজকে অনগ্রসর, অশিক্ষিত, আরব-ইরানমুখী এবং হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মার্ক্সিস্ট ঘরানার প্রখ্যাত পণ্ডিত বদরুদ্দীন উমর প্রবন্ধের শুরুতে সামাজিক শ্রেণিতত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা থেকে সরে এসে উপরে উল্লিখিতদের মতোই গোঁজামিল দিয়ে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক একটা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন যা বাঙালি মুসলমান সমাজ সম্পর্কিত stereotype-গুলোই পুনরুৎপাদন করে[14]। একইভাবে প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবউদ্দীন আহমেদ[15] বাঙালি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদভিত্তিক ও জাতিসত্তাগত পরিচয় নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধের উপসংহার টেনেছেন তাদের মধ্যকার ছ্যাঁচ্চোর (Lumpen) স্বভাবের উল্লেখ দিয়ে। আর এইসব ফলাফল এসেছে যথারীতি পদ্ধতিগত ও তত্ত্বীয় নানান গোঁজামিলের মধ্য দিয়েই।


যে কোনো গবেষণায় তত্ত্বজ্ঞান অপরিহার্য। সাধারণভাবে, গবেষণা প্রকাশনায় তথ্যের বিশ্লেষণভিত্তিক ব্যাখ্যাসমূহকে উপস্থাপন করা হয় বাস্তব (fact) বা জ্ঞান (knowledge) হিসেবে। কিন্তু কোনো বিষয়ের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য নিজে নিজেই জ্ঞান হিসেবে হাজির হয়না। বরং প্রাপ্ত তথ্যকে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সংগ্রহ করতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয় এবং সর্বশেষে ব্যাখ্যা করতে হয়। অর্থাৎ, বাস্তবিক কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে কিছু তথ্য (সংখ্যাগত (quantitative), বা গুণগত (qualitative), বা উভয়ই) সংগ্রহ করলেই তা জ্ঞানে পরিণত হয় না। সেই তথ্যকে অনিবার্যভাবেই ব্যাখ্যা করার দরকার হয়। তারপরেই কেবল আসে জ্ঞান। আর এই তথ্যের ব্যাখ্যা (interpretation) অর্থপূর্ণ হয় কেবলমাত্র সুনির্দিষ্ট কোনো তত্ত্বীয় কাঠামোর মধ্যেই। আলোচ্য ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ সংক্রান্ত বয়ান হতেই উদাহরণ দেওয়া যাক। এখানে বাঙালি মুসলমান সমাজকে মোটাদাগে পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, জ্ঞানবিমুখ, হিন্দু-বিদ্বেষী ইত্যাদি নানারকম নেতিবাচক বিশেষণে (stereotype) পরিচিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, stereotype সম্পূর্ণ ভুল বা মিথ্যা নয়, বরং আংশিক সত্যের অপব্যাখ্যাই এসবের ভিত্তি[16]। এইসব ধারণার উৎপত্তি সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানান গবেষণায়। সাধারণত গবেষকরা বাংলাদেশি মুসলমান সমাজে শিক্ষায় অনগ্রসরতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদি অনেক বিষয় চিহ্নিত করেন আরোপিত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যাবলীর প্রমাণ হিসেবে। অর্থাৎ, গবেষকরা এইসব তথ্যকে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে মুসলমান সমাজের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেন। দেখা যাক, এইসব গবেষণায় তথ্য ও তার ব্যাখ্যার প্রকৃত স্বরূপ কেমন।


ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে স্কুলে ভর্তি এবং উত্তীর্ণের হার প্রতিবেশি হিন্দু সমাজের তুলনায় কম। এই তথ্য নিজে নিজেই কোনো প্রকার জ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয়না। বরং এই তুলনামূলক তথ্যকে ব্যাখ্যা করে গবেষক এমন উপসংহারে আসে যে, বাঙালি মুসলমান শিক্ষাবিমুখ। তথ্যের এই ব্যাখ্যায় আসতে গবেষককে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ, আগে থেকেই সমাজে এই তত্ত্বীয় অনুমান জারি আছে যে, মুসলমান সমাজ আধুনিক শিক্ষায় অনাগ্রহী। কিন্তু হিন্দু সমাজকে নিয়ে একই রকম তথ্য পাওয়া গেলেও অনুরূপ ব্যাখ্যা করা হবে না। কারণ, বাঙালি হিন্দুরা আধুনিক শিক্ষায় অনাগ্রহী এমন কোনো তত্ত্বীয় কাঠামো নেই (বরং উল্টোটি আছে, তথা হিন্দুরা বিদ্যানুরাগী)। অর্থাৎ, বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে শিক্ষার তুলনামূলক কম হারকে একটা সুনির্দিষ্ট তত্ত্বীয় কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে তাদের উপর একটা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়, তথা অপরায়নকে (othering) প্রতিষ্ঠা করা হয়। অথচ, উল্লিখিত পূর্বধারণা বাদ দিলে গবেষক স্বভাবতই এই প্রশ্ন করবে যে, কেন মুসলমান সমাজ শিক্ষায় তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর, যার ব্যাখ্যা হিসেবে অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণের মধ্যে আসবে জমির মালিকানার অভাব এবং কলোনিয়াল প্রশাসনে তাদের প্রবেশের সীমিত সুযোগ।


বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে, গবেষণায় এবং মিডিয়ায় বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে এই যে গোঁজামিলের চর্চা, একে গায়র্ত্রী স্পিভাকের ভাষায় বলা যায় জ্ঞানের সহিংসতা বা জ্ঞান-সন্ত্রাস (Epistemic Violence)[17]। এতে কোনো সন্ত্রাসী অস্ত্রহাতে দুর্বল শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পরেনা। বরং, এই সহিংসতা ঘটে আলোকোজ্জ্বল জ্ঞানের বহ্নিশিখার মাধ্যমে, বাতিঘর বা আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিত গুণীজন এবং তাদের গুণমুগ্ধ, ডিগ্রিধারী, বুদ্ধিজীবীদের হাতে। জ্ঞানের এই সহিংসতার তিনটি বৈশিষ্ট্য/দিক আছে :

(১) কর্তার স্থানে থাকে গবেষক/স্কলার/বুদ্ধিজীবী,

(২) লক্ষ্যে থাকে ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠী (other) এবং

(৩) তথ্যের ব্যাখ্যাকে উপস্থাপন করা হয় প্রশ্নাতীত, তথা চূড়ান্ত জ্ঞান (truth) হিসেবে।


পাঠ্যসূচী, সমাজ গবেষণা, রাজনৈতিক কর্মসূচী, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি মাধ্যমে বিদ্যমান নেতিবাচক পূর্বধারণাগুলো আমাদের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে এমনভাবে আবদ্ধ করে রাখে যে, গবেষক বা লেখক সেইসব নেতিবাচক পূর্বধারণাকেই (stereotype) ক্রমাগত পুনরুৎপাদন করে চলে। এমনকি লেখক/গবেষক সচেতনভাবে মুসলমান-বিদ্বেষী না হয়েও অথবা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও একই ধারা অনুসরণ করেন। যেমন, প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদের রচিত ‘বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা’ বইটি[18]। এখানে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন : "বাঙালি মুসলমান ভাগ্য-বিড়ম্বিত তার নিজের স্বভাব-দোষে, ভাগ্যচক্রে এবং অন্যের কারণেও। বার বার হয়েছে সে ভাগ্য-বিড়ম্বনার শিকার।" - আহা, কি নিদারুণ একটা ট্র্যাজিক ব্যাপার, তাই না? প্রথম দেখায় বাক্যটিতে মুসলমান সমাজের জন্য সহমর্মিতায় পূর্ণ মনে হলেও আসল কথাটা কিন্তু একেবারে সোজা - বাঙালি মুসলমান যে ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটা জনগোষ্ঠী/সম্প্রদায়, তার দায় এই মুসলমানদেরই। নিজেদের অশিক্ষা, প্রগতির পথে চলায় অক্ষমতা, রক্ষণশীলতা ইত্যাদিই তাদের ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য দায়ী। যেন তাদের উপর জমিদারি ব্যবস্থা চেপে বসে ছিল না, যেন ইংরেজ কলোনিয়াল শোষণ ছিল না, যেন তাদেরকে শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতিতে বঞ্চিত করা হয়নি।



ইতিহাস গবেষণা একটা পেশাদারি (professional) কাজ, যা যথাযথভাবে করতে গেলে সুনির্দিষ্ট দক্ষতার (expertise) প্রয়োজন হয়। আমরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে যেমন ইঞ্জিনিয়ারের কাছে না গিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই, তেমনি ইতিহাস জানার জন্যও যেতে হবে উপযুক্ত ট্রেনিং নিয়ে পেশাদার হিসেবে স্বীকৃত ঐতিহাসিকের কাছে। আর এইসব ট্রেনিং হতে হবে দক্ষ ঐতিহাসিকের তত্ত্বাবধানে উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে। পল্লি-চিকিৎসক দিয়ে ওষুধের ফার্মাসি, বড়জোর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজ চলে। কিন্তু রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার জন্য অন্তত এমবিবিএস পাশ করতেই হয়। অনুরূপভাবে ইতিহাস চর্চায় যোগ্য লোকের দরকার। দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চার কাজটা তুলে দেওয়া হয়েছে অপেশাদার ঐতিহাসিকদের হাতে। যেমন, ডেইলিস্টার-প্রথম আলো গ্রুপের প্রকাশিত সৈয়দ আবুল মকসুদের উল্লিখিত বইটি। এর মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করা যায় দুই শব্দে – ভিকটিম ব্লেমিং, অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তিই অপরাধী,আক্রমণকারী না। এই গ্রুপ আগেও এমনি করে গোলাম মুরশিদকে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস’ নামের একটা গোঁজামিলে ভরা ইতিহাস বইয়ের জন্য পুরস্কৃত করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় কুমার রায়ের লেখা ‘আদি বাঙালি : নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭)’[19] একই ধারার বই, যেখানে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের কোনোরূপ সংজ্ঞা ছাড়াই বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসের আলোচনা করা হয়েছে।একইভাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস[20]। উচ্চতর পর্যায়ে সমাজ, সংস্কৃতি বা ইতিহাস বিষয়ে এদের কারোরই তত্ত্বীয়, পদ্ধতিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং গবেষণা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পদ আর বাংলা গদ্য-লেখায় পারদর্শিতা ছাড়া তাদের আর কোনো দক্ষতা নেই উল্লিখিত বইগুলো লেখার জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বই এবং প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সেগুলো গ্রহণযোগ্য জ্ঞানের স্বীকৃতি পেয়েছে।অথচ, একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই দেখা যায় যে, এইসব লেখা গোঁজামিলে ভরা। আর উল্লিখিত বিষয়ে সত্যিকার পেশাগত দক্ষতা থাকলে সুনির্দিষ্ট করেই চিহ্নিত করা যায় এইসব রচনার মধ্যকার তত্ত্বীয় এবং পদ্ধতিগত ভুলভাল যার খানিকটা উপরে আলোচনা করেছি।


আধুনিক, মূলধারার শিক্ষায়তনে বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমান সমাজ বিষয়ক গবেষণা আদতে জ্ঞানের সহিংসতা। গবেষণার নামে ক্রমাগতভাবে অপরায়িত (othered - marginalized, racialized, persecuted) মুসলমান সমাজকে অশিক্ষিত, অক্ষম, প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এই যে জ্ঞানের উৎপাদন ও বিস্তারের প্রক্রিয়া, এইটাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সর্বপ্রথম দরকার চলমান বয়ানটিকে প্রশ্ন করার মতো আত্মবিশ্বাস। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষা ছাড়াই শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান (যেমন, অধ্যাপক, গবেষক), সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন পরিচয় (লেখক, বুদ্ধিজীবী), প্রশাসনিক ক্ষমতা (যেমন সচিবসহ নানা প্রকার উচ্চ পদাধিকারী) ইত্যাদির আশ্রয়ে থেকে বাঙালি মুসলমানের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ, বই ইত্যাদির প্রকাশনা এবং সভাসমিতির আলোচনাগুলোতে ‘পদাধিকারী বিশেষজ্ঞ’দের উপস্থাপিত কথা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস স্থাপন না করে বরং নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের খোঁজ করতে হবে। অসুখ হলে যেমন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিক্ষিত ডাক্তারের কাছে যাই, তেমন।


উল্লিখিত বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সেইসব বিষয়ে গবেষক হিসেবে স্বীকৃত পণ্ডিত এবং তাদের রচিত নির্ভরযোগ্য বই বা প্রবন্ধ যে নেই, তা কিন্তু নয়।যেমন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে শিক্ষিত মহলে হিন্দু-মুসলিমের সমন্বয়ে একটা অভিন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদ কল্পনা করা হয় যেখানে মুসলমানরা অংশ নিতে অপারগতা এবং তাদের এই অনাগ্রহকে ব্যাখ্যা করা হয় মুসলমান সমাজের জাতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে। অথচ, পার্থ চ্যাটার্জী ‘The Nation and its Fragments’ বইয়ে দেখিয়েছেন যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানেই হিন্দু জাতীয়তাবাদ[21]। তিনি উনিশ শতকের শেষে বাংলায় প্রচলিত ইতিহাসের পাঠ্যবইসমূহ বিশ্লেষণপূর্বক দেখান যে, তাতে মুসলমান সমাজ এবং মুসলিম শাসকদের উপস্থাপন করা হয় বিদেশি, বিলাসী, নারী আসক্ত, নিষ্ঠুর ইত্যাদি হিসেবে।হিন্দু রচয়িতা তো বটেই, এমনকি মুসলমান রচয়িতাদের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষণীয়, যেমন ঢাকা থেকে ১৮৭০ সালে প্রকাশিত সৈয়দ আব্দুল রহিম রচিত ইতিহাস বই। পার্থ চ্যাটার্জী জাতীয়তাবাদ নিয়ে রচিত বঙ্কিমের প্রবন্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চারটি ধরন খুঁজে পান, যার মধ্যে বঙ্কিম মুসলিম জাতীয়তাবাদকে স্থান দেন সর্ব নিম্নে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের এই চিন্তা ও প্রকাশের সম্ভাবনাটুকুও চাপা পড়ে যায় গত শতকের আর্য-হিন্দু-ভারতবর্ষের ইতিহাসিক চিন্তা ও সংগ্রামের ইতিহাসের পেছনে। অর্থাৎ, ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজ যে হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে আছে, তার জন্য মুসলমানদের অক্ষমতা, শিক্ষার অভাব বা রক্ষণশীলতার থেকেও পার্থ চ্যাটার্জি বেশি দায়ী মনে করেন তৎকালীন বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা।


ইংরেজ উপনিবেশের পাটাতনে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার অভাব, সেখান থেকে প্রশাসনিক চাকুরি এবং প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যে সীমিত সুযোগ এবং এর ফলে সার্বিকভাবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ববাংলার সংখ্যাগুরু মুসলমান সমাজ যে পিছিয়ে ছিল একথাটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব এবং মুসলমান সমাজ নিয়ে নেতিবাচক পূর্বধারণার প্রভাবে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বয়ানের লেখক-গবেষকরা এই পিছিয়ে পড়ার প্রকৃত কারণ অনুধাবনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়ে গোঁজামিলের আশ্রয় নেয়[22]। ফলে বুঝে বা না-বুঝে তাদের মনের মধ্যে বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে গেঁড়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস (dogma)-এর ভিত্তিতে তারা যেসব বই বা প্রবন্ধ রচনা করেন, তা অনিবার্যভাবেই হয়ে ওঠে কু-ইতিহাস, কু-সাহিত্য আর অপবিজ্ঞান।



[1] আহমদ ছফা :নির্বাচিত প্রবন্ধ, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০২ [2] Rafiuddin Ahmad (1981). The Bengal Muslims 1871-1906: A Quest For Identity. Oxford University Press. [3] মীর মশাররফ হোসেন, বিষাদ সিন্ধু, উদ্ধার পর্ব, দ্বিতীয় প্রবাহ। কিতাব মহল, কলিকাতা, ঢাকা, রাজশাহী। পৃষ্ঠা, ২৪৭ থেকে ২৫০। [4] এটিএম আনিসুজ্জামান (২০১২) মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, প্রথম চারুলিপি প্রকাশ, ঢাকা। [5] সলিমুল্লাহ খান, (২০১৩) [প্রবন্ধের প্রথম প্রকাশকাল ২০০১]। 'আহমদ ছফার সাধনা'। আহমদ ছফা সঞ্জীবনী। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩৯–৪৭। [6] ‘বাঙালি মুসলমানের মন কি বদলেছে?’, DW পত্রিকা, ৩০ অক্টোবর, ২০২০, https://www.dw.com/bn/বাঙালি-মুসলমানের-মন-কি-বদলেছে/a-55446402 [7] Rahman MM. (2018). Triangular Confluence: Islam and Modernity in Bangladesh. Journal of Asian and African Studies. 53(6):866-879. [8] সাত্তার, সরদার আবদুস (২০১৭), "বাঙালি মুসলমানের মানসদর্পণ", আহমদ ছফা: আলোকপথের অভিযাত্রী, ঢাকা: সুচয়নী পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৭৫–২৯৮ [9] ফারুক ওয়াসিফ (২০২০), আহমদ ছফার মন ও ‘বাঙালি মুসলমান’ (অনলাইন আলোচনা), সংবিৎ, ৩ অক্টোবর, ওয়েবলিঙ্ক - https://www.youtube.com/watch?v=dQeHeeg5vBk [10] আনিসুজ্জামান, প্রাগুক্ত [11] এক্ষেত্রে সাধারণ পাঠকের জন্য এম আর আখতার মুকুলের রচিত ‘কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ বইটা দারুণ একটা সূচনা দিবে। [12] গোলাম মুরশিদ (২০০৫) হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, (প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১২), অবসর প্রকাশনী, ঢাকা। [13] প্রথম প্রকাশ ১৯৬৪ সালে; আর এই আলোচনায় উদ্ধৃতিগুলো ২০১২ সালে মুদ্রিত সংখ্যা থেকে নেওয়া। [14] মোহাম্মদ আজম (২০২১), “বাঙালি মুসলমানর ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’: এক হীনমন্য মিথের ইতিহাস-ভূগোল”, তত্ত্বতালাশ, ১ম সংখ্যা, জুলাই। [15] Ahmed, A. I. Mahbubuddin (2019). The Ethno-class Formation and Contemporary National Identity in Bangladesh. In Mukherji, P. N., Jayaram, N. and Ghosh, B. N. (eds.) Understanding Social Dynamics in South Asia: Essays in Memory of Ramkrishna Mukherjee. Springer, Singapore. [16] Kanahara, Shunsuke (2006). A Review of the Definitions of Stereotype and a Proposal for a Progressional Model. Individual Differences Research, 4(5): 306-321. [17] Spivak, G. C. (1988). Can the subaltern speak? In N. Carry & L. Grossberg (Eds.), Marxism and the interpretation of culture (pp. 271–313). Urbana-Champaign, IL: University of Illinois Press. [18] সৈয়দ আবুল মকসুদ (২০১৯) বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা, ডেইলি স্টার বুকস, ঢাকা। [19] অজয় কুমার রায় (১৯৯৭) আদি বাঙালী : নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। [20] মুহম্মদ জাফর ইকবাল (২০০৯) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রতীতি প্রকাশনা, ঢাকা। [21] Partha Chatterjee: The nation and its fragments: colonial and postcolonial histories. Princeton, NJ: Princeton University Press [22] এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। কলা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের নানান শাখায় গবেষক এবং বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি মুসলমান সমাজ নিয়ে গবেষণা, লেখালেখি এবং আলোচনা করলেও তাদের সকলের উপসংহারে এই যে মিল দেখা যায়, এটা এজন্য নয় যে তারা সবাই শলাপরামর্শ করে এমন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন, বা তারা সম্মিলিতভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে (intentionally) হেয় করতে তৎপর। বরং,এমনটি হওয়ার কারণ বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিদ্যমান জ্ঞানকাণ্ড (Discourse), যা জ্ঞানচর্চার সামগ্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে কি প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে, কোন তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে, কোন ধারায় তা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে হবে, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট একটা ধারায় পরিচালিত করে। Discourse কি এবং কিভাবে এটি জ্ঞানচর্চাকে প্রভাবিত করে তা জানার জন্য শুরু হিসেবে আমি এখানে একটা সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের উল্লেখ করছি, আরো বিস্তারির জানার জন্য গুগল স্কলারে সার্চ করলে অনেক রেফারেন্স পাওয়ার যাবে। Clayton J. Whisnant, “Foucault & Discourse: A Handout for HIS 389,” http://webs.wofford.edu/whisnantcj/ his389/foucualt_discourse.pdf

322 views0 comments
bottom of page