এক দৈনিকে ‘বাংলাদেশেই অধ্যাপক হওয়া সবচেয়ে সহজ’ শিরোনামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য সারসংক্ষেপ আকারে শুরুতেই আলাদা বক্সে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে —বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হতে লাগে মাত্র ১২ বছর, যেখানে অন্যান্য দেশে লাগে ২০ বছর, বিভাগে সব শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা অন্যান্য পদের থেকে বেশি এবং অধ্যাপক পদে ২৯ বছর থাকার পরেও প্রকাশনার জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কেউ এমন বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হবেন। শিক্ষক সমাজ এই ক্ষোভ ব্যক্ত করছেও সোস্যাল মিডিয়ায়।তাদের মূল অভিযোগ হলো, এ প্রতিবেদন মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাকে হেয় করতেই প্রকাশ করা হয়েছে। দেশে বিদ্যমান বাস্তবতায় শিক্ষকদের এ অভিযোগ যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।সম্প্রতি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি, কতিপয় উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও আত্মীয়করণের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে আমলা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা এবং বেতন-ভাতাদির সুবিধা কম বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ভাবে শিক্ষকতাকে হেয় করা হয়েছে বলেও সাধারণভাবে একটা যৌক্তিক অনুমান জন্ম নিয়েছে শিক্ষক সমাজে।এ পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত প্রতিবেদনকে মানহানিকর ছাড়া আর কিছুই বলার উপায় নেই। কেন, সেটা আগে বলা যাক—
অন্যকোন দেশের সঙ্গে এ প্রতিবেদক বাংলাদেশের তুলনা করেছেন তার উল্লেখ নেই।কিন্তু যেহেতু অনুমান করার স্বাধীনতা পাওয়া গেছে, তাই তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেই অনুমিত তুলনাটা আলোচনা করি।প্রতিবেদনটি যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগের তথ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছে, আমিও তেমনি আমেরিকার অন্যতম ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তথ্য দিয়ে আলাপ শুরু করি।এই বিভাগ পছন্দের কারণ এটি আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানে র্যাংকিংয়ে প্রথম ১০টির একটি, এখানে নিজ নিজ বিশেষায়নে বিশ্বখ্যাত কয়েকজন অধ্যাপক আছেন এবং এখান থেকে পিএইচডি করে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবছর পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকতার পদেযোগ দেন।তো এ বিভাগের ওয়েব সাইটে গেলে দেখা যায় যে এখানে মোট শিক্ষক ৩৪জন, এর মধ্যে ২৪জনই অধ্যাপক।মাত্র দুজন সহযোগী অধ্যাপক আর আটজন সহকারী অধ্যাপক।এই যদি হয় বিশ্বের অন্যতম প্রখ্যাত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পদবিন্যাসের অবস্থা, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ কি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব বিভাগে পদবিন্যাসে অধ্যাপকের সংখ্যা অধিক থাকাটা সমস্যা হবে কেন?
আলোচ্য প্রতিবেদনের আরেকটা যে বিষয় একে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি নিছক কূটনামিতে পরিণত করেছে, তাহলো অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সময়কাল নিয়ে তুলনা।উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে অধ্যাপক হতে লাগে ১২বছর আর প্রতিবেদকের কল্পিত বিদেশে সেই সময়কাল ২০বছর।কল্পিত বললাম এজন্য যে বাস্তবে বিদেশেও বাংলাদেশের মতোই ১২বছর লাগে নিয়োগ প্রাপ্তি থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে।ক্ষেত্র বিশেষে দু-এক বছর এদিক-ওদিক হলেও অধিকাংশ শিক্ষকের বেলায় সময়কাল সেই ১২বছরই।উদাহরণ দিই আবার সেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলসের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে।সেখানে একজন শিক্ষক সাধারণত যোগদেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে।তিন বছর পর একটা প্রারম্ভিক রিভিউ হয় তার গবেষণা, শিক্ষাদান এবং একাডেমিক সার্ভিসের।ছয় বছরের মাথায় আবার অনুরূপ রিভিউ শেষে পদোন্নতি হয় সহযোগী অধ্যাপক পদে। একই ধরনের রিভিউ শেষে আবার ছয় বছর পর পদোন্নতি হয় অধ্যাপক হিসেবে।
তবে বিশাল পার্থক্য আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভিউ প্রক্রিয়ায়।যে জন্য আলোচ্য প্রতিবেদনকে নিছক কূটনামি মনে করলেও এর শিরোনামের সঙ্গে আমি একমত।বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হওয়া আসলেই আমেরিকা কি আর কোনো উন্নত বিশ্বের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় একেবারেই সহজ।
শুরু করি নিয়োগ প্রক্রিয়া দিয়ে।আমেরিকা বা অন্যকোনো উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপনে সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ থাকে কোন বিশেষায়নে গবেষণায় পিএইচডি এবং গবেষণায় পারদর্শিতার প্রমাণস্বরূপ প্রকাশনা।আর আমাদের দেশের নিয়োগের বিজ্ঞাপনে থাকে শুধু পদের নাম, কোনো নির্দিষ্ট বিশেষায়নের উল্লেখ ছাড়াই।প্রথম শ্রেণীতে অনার্স আর মাস্টার্স থাকলেই প্রার্থীকে যোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।বিশেষ বিশেষায়নে গবেষণা এবং প্রকাশনা থাকাটা বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা ছিল, যেহেতু মাস্টার্স পর্যায়ের পাঠ বিশেষায়িত এবং থিসিস গবেষণাভিত্তিক।বিশেষায়নকে বাদ দেয়া এবং গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনাকে উপেক্ষা করা দিয়ে যে শুরু, সেটাই ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে পরবর্তী ধাপগুলোয়।প্রভাষকের পদে যোগদানের পর নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে (যেমন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে স্থায়ীভাবে সেটল করা) অথবা অন্যকোনো ব্যতিক্রম (যেমন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়া) ছাড়া কারো চাকরিচ্যুতি ঘটেছে বা কারো পদোন্নতি হয়নি এমনটি শোনা যায়না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ ছিলাম চার বছরের বেশি।এর সঙ্গে সাত বছর ছাত্রকালীন নিজ বিভাগে দেখেছি তিনটা নিয়োগ প্রক্রিয়া।এসবের ভিত্তিতে জেনেছি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য উন্নত বিশ্বে যেখানে ওই বিষয়ের মধ্যকার বিশেষ কোনো বিশেষায়নে (যেমন সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব, উন্নয়নের সমাজবিজ্ঞান, রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান, শ্রমের সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি) যোগ্যতা প্রমাণের দরকার হয়, বাংলাদেশে দরকার হয় ওই বিষয়ের ‘বাইরের বিশেষ’ যোগ্যতা, যেমন রাজনৈতিক মতাদর্শ, প্রভাবশালী শিক্ষকের আনুকূল্য ইত্যাদি। ফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা ব্যক্তিগতভাবে মেধাবী ছাত্রছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও যেসব ‘বাইরের’ যোগ্যতা নিয়োগকে (এবং পরবর্তী সময়ে পদোন্নতিকে) প্রভাবিত করে, সেগুলোই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।বিশেষভাবে কোনো বিশেষায়নে নিজেকে নিবিড়ভাবে নিয়োজিত না করে বরং তারা রাজনৈতিক মতাদর্শ বা প্যাট্রন-শিক্ষকের মুখাপেক্ষী হয়েই থেকে যান।২০১৭ সালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণাও পরিচালিত হয়নি।এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ গবেষণা বাজেটের ৪০শতাংশ অব্যবহূত থেকে গেছে।শিক্ষকদের অনেকেই অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পর্যাপ্ত গবেষণা ফান্ড নাথাকার কথা।কিন্তু অতিনগণ্য পরিমাণে যেটুকু আছে, সেটাও যদি ব্যবহার করা নাহয়, তাহলে ফান্ডের অপ্রতুলতার অভিযোগ ধোপে টেকেনা।
আমার জানামতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা মাসিক বেতনের সঙ্গে ৫হাজার টাকা পান গবেষণা ভাতা হিসেবে, যা বছর শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ৬০হাজারে।বিজ্ঞান অনুষদে গবেষণায় সাধারণত উচ্চমূল্যের গবেষণা সরঞ্জাম কেনার জন্য এভাতা অপ্রতুল হলেও সামাজিক বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য অনুষদে এটাকায় গবেষণা করতে পারার কথা।কারণ এসব বিভাগের গবেষণায় ল্যাব বা উচ্চমূল্যের সরঞ্জাম দরকার হয়না।তদুপরি ছাত্রদের দিয়ে সাশ্রয়ী মজুরিতে অনেক গবেষণার কাজ করানো সম্ভব।তারপরেও এসব অনুষদের এত এত বিভাগে উল্লেখ করার মতো কোনো গবেষণা হয়না কেন? শিক্ষকতার পদে যারা আছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ করার উপায় নেই।কারণ এরাই বিদেশে পড়তে গিয়ে মানসম্মত গবেষণা ও প্রকাশনা বের করেন।অথচ দেশে ফেরত এলে তাদের খুব কমই গবেষণা ও প্রকাশনায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়।
গবেষণা হয় না, তাই গবেষণাভিত্তিক প্রকাশনাও হয়না।অতএব, সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও অনুসৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার যোগ্যতা পরিমাপের এ মানদন্ড বাংলাদেশে খাটেনা।এজন্যই বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পর গবেষণা এবং সেই ফলাফলভিত্তিক প্রকাশনা ছাড়াই পুরো শিক্ষকতার ক্যারিয়ার পার করা যায়।আমার যে বাল্যবন্ধুটি একটি নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬বছর বয়সে অধ্যাপক হয়েছে, পরবর্তী ২০ কি ২৫বছরে তার আরেকটা গবেষণা বা প্রকাশনারও দরকার হবেনা স্বপদে বহাল থাকতে।
সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমমানের অন্য কর্মকর্তাদের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেনা সত্য।অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায়ও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদি কম।পাশাপাশি এটাও তো সত্য যে বিদেশের কলিগদের সঙ্গে তুলনীয় গবেষণা বা প্রকাশনা না-করেই বাংলাদেশে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া এবং পদে বহাল থাকা সম্ভব।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হলে গবেষণাকে নিয়োগ ও পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত অর্থাৎ সরকারের সরাসরি কর্তৃত্বের অধীন নয়। অতএব, কাজটি করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই। গবেষণার সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নয়, বরং প্রশাসনিক কাঠামোগত দুর্বলতাই দায়ী বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও শিক্ষকতার মানের ও মর্যাদার ক্রমাবনতির জন্য। অতএব, সংস্কার করতে হবে এখানেই। গবেষণার সুযোগ-সুবিধা আর শিক্ষার মানোন্নয়ন আপনা আপনিই চলে আসবে সঠিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে।
নোট- লেখাটি ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ দৈনিক বণিকবার্তায় প্রকাশিক হয়েছিল।
Comments