top of page
Hasan Mahmud

জঙ্গিবাদের সমাজতত্ত্ব, অথবা উগ্রবাদের সমাজ-গবেষণার ইশতেহার


ছবিঃ গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি-হামলা, বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশিত ছবি


১ 


গতকাল থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজকে বিনাশুক্লে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ব্যবহার করতে দেওয়ার চুক্তি কার্যকর হওয়ার কথা। এইটা সেই চুক্তি, যার সমালোচনা করে ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ার কারণে গত বছর অক্টোবরের ৬ তারিখে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে বুয়েটের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মিরা রাতভর পিটিয়ে হত্যা করেছে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে যে, নিহত আবরার ছাত্র শিবিরের রাজনীতি করত যার প্রমাণ ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের সম্পাদিত চুক্তির, তথা সরকারের সমালোচনা করা। অথচ, আবরারের বাবার বরাতে জানা যায় যে, তারা পারিবারিকভাবেই আওয়ামীলীগের সক্রিয় রাজনীতিতে ছিল। এই হত্যাকাণ্ড ফেসবুকসহ মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় তোলে। অভিযুক্তরা সনাক্ত ও গ্রেফতার হয়ে জেল-হাজতে যায়। কিন্তু সরকারের বিরোধী সমালোচনাকে জামাত-শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন-নিস্পেষণের চক্র চলতেই থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রেক্ষিতে ফেসবুকে সমালোচনামূলক মন্তব্য করায় মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হন দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (একজন আওয়ামীলীগের একটা জেলাকমিটির সাবেক সম্পাদক, আরেকজন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নের্ত্রী) আর একজন চৌদ্দবছরের কিশোর। অভিযোগ একই রকমঃ এরা জামাত-শিবিরের সমর্থক। অতএব, এদেরকে মামলা দিয়ে, শারীরিক-সামাজিক নির্যাতন করে দমিয়ে রাখতে হবে। ফেসবুকে, বিশেষ করে ইউনিভার্সিটি টিচারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রুপে, বেশ জোরালো প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে এহেন ঘটনার।


বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যেখানে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বিশ্বব্যাপী ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করছে, সেই বাংলাদেশের মধ্যে নাগরিকদের এহেন নিরাপত্তাহীনতা খুবই হতাশাজনক। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মত একটা মৌলিক দায়িত্ব পালনে সরকারের ব্যর্থতা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অনিচ্ছা এতো প্রকট যে, আমজনতার মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তার অভাববোধ সর্বাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিজে আক্রান্ত হয়েও কোনপ্রকার প্রতিকারের আশা ত্যাগ করেছে। আবারও আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় মুখ বুঁজে অন্যায়, অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, ব্যক্তির নিরাপত্তা ক্ষয়ে যেতে যেতে এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, এমনকি জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা-প্রকল্পে জড়িত ডঃ মোবাশ্বিরও ২০১৭ সালে গুম হয়েছিলেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্টতা দাবিকারী এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও একদিন ফেসবুকের মাধ্যমে নিজের গুম হওয়ার সম্ভাবনা জানিয়ে বলেন যে, ‘গুম’ এর আশংকা বিরোধীদল বা সরকার সমর্থক সকলেরই আছে। অর্থ্যাৎ, ‘গুম’ হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি, সরকার-বিরোধী নির্বিশেষ সকলেই একটা আতংকের মধ্যে আছে। নানান সূত্রের বরাতে প্রাপ্ত সংখ্যাগত তথ্যও এই আতঙ্কের ভিত্তিকে জোরালো করছে। যেমন, জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশ্বখ্যাত গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট অধ্যাপক আলী রিয়াজের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি ১০০ মিনিটে একজন গুম হচ্ছে, যাদের মধ্যে অল্প কিছু ব্যক্তির লাশ পরবর্তীতে পাওয়া গেলেও অধিকাংশের ভাগ্যই অজানা থেকে যাচ্ছে। 


জনসাধারণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাবোধ কতটা সর্বাত্নক, তা বোঝানোর জন্য ফেসবুক থেকে দুজন নারীর মধ্যকার কথোপকথন থেকে দুটো লাইন উদ্ধৃতি করছিঃ 

নারী-১ঃ “ডাক্তারি ট্রিটমেন্ট ছাড়া আর কিছুই করো না! বিচার ত পাবা না, উল্টা ওকেই হয়তো বেঁধে নিয়ে যাবে!!

নারী-২ঃ সেটাই আসল এখন।” -

 

ঘটনার প্রেক্ষিত, রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়ির এক সাধারণ ভদ্রলোকের মাথায় পুলিশ লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত করে দেওয়া। ঐ ভদ্রলোক বিরোধীদলের নেতা/কর্মি/সমর্থক না, শাহবাগের আন্দোলনের বিরোধী না, এনজিও ব্যবসায় জড়িত না, এমনকি কারো পরকীয়া প্রেমিকও না। তারপরেও তিনি প্রকাশ্য জনপথে পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই বাসা থেকে বের হওয়ার পথে এমনটি কল্পনাও করেননি। এটা সুস্পষ্ট অন্যায়, কিন্তু সেটাও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছে না ভুক্তভোগী এবং তার স্বজন ও শুভাকাঙ্খীরা, আইনের আশ্রয় চাওয়া ত দূরের কথা! 


জঙ্গিবাদ একটা অপরাধ। কারণ, জঙ্গিরা অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইন এবং জনমত তাই অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু এই জঙ্গিবাদ এখন সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিতভাবে আরেকদিক থেকেও ব্যক্তির জন্য মরণফাঁদ হয়ে দেখে দিচ্ছে। যে জঙ্গিবাদের নির্মূল কামনায় জনগণ নির্বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা বা গুম করার পক্ষে এতদিন সরব সমর্থন দিয়ে এসেছে, এখন সেই জঙ্গিবাদের জুজুই এখন আমজনতার গুম হওয়ার কারণ হিসেবে হাজির হয়েছে। এমনকি ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ও ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। - এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয় নাই, উপর থেকে কেউ হুকুম দিয়েও এইটা তৈরি করে নাই। এর জন্ম ক্ষমতাসীন সরকারের কুশাসন থেকে হলেও এটি স্থায়িত্ব পেয়েছে জনগণের বৃহৎ অংশের মৌন সম্মতিতে। বাংলাদেশ ক্রমাগত এই অবস্থার স্থায়িত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে। আপনার, আমার, আমাদের মৌন সম্মতি নিয়ে। শুধুমাত্র সরকারের কাছে নিরাপত্তার দাবী জানিয়ে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এর জন্য সর্বাগ্রে জনতার মধ্যে জঙ্গিদেরকে বিনাবিচারে হত্যার পক্ষে যে সামাজিক রায় জারি আছে, তার মূলোৎপাটন করতে হবে। আর এজন্য দরকার বিশেষজ্ঞদের গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান এবং তার ভিত্তিতে জঙ্গিবাদ বিষয়ক সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক গনচেতনা তৈরি করা। এক্ষেত্রে প্রচলিত মতামতের বাইরে গিয়ে জঙ্গিবাদের উৎস অনুসন্ধান এবং প্রতিরোধে সমাজবিজ্ঞান দিতে পারে সবথেকে কার্যকরী সমাধান।   

প্রথমে আমি কিভাবে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে জঙ্গিবাদের উৎস অনুসন্ধান করতে হবে সেই নিয়ে খানিকটা আলাপ করবো। এরপর এই ধারায় জঙ্গিবাদ নিয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিয়েও খানিকটা আলোকপাত করবো। গবেষকদের পাশাপাশি আমজনতার করণীয় সম্পর্কেও খানিকটা আলাপ থাকবে।  




সমাজবিজ্ঞানের সবথেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ব্যক্তির যাবতীয় অভিজ্ঞতা এবং কর্মতৎপরতাকে সমাজের প্রভাবের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা। অর্থ্যাৎ, আমরা যেখানে কারো সাফল্য, ব্যর্থতা, ইত্যাদিকে ব্যক্তিগত যোগ্যতা বা অযোগ্যতা দিয়ে ব্যাখ্যা করি, সেখানে সমাজবিজ্ঞানী তা’ ব্যাখ্যা করে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থা (যথা, শ্রেণী, লিঙ্গ, বয়স, জাতিগোষ্ঠী, পেশা) দিয়ে যেখানে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ খুব সামান্য, অথবা একেবারেই শূন্য। যেমন, কারো জন্ম দরিদ্র মজুরের ঘরে হবে নাকি ধনী শিল্পপতির ঘরে হবে তা’ নির্ধারন করা ব্যক্তিগতভাবে কারো পক্ষে সম্ভব নয়; অথচ এই জন্মগত এই পার্থক্যই পড়াশোনায় সাফল্যের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যক্তির ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ধারন করে দেয়। তবে এইটাও আবার দাবী করার উপায় নেই যে, গরীবের ঘরে জন্মালেই অবধারিতভাবে পড়াশোনা আটকে যাবে, উল্টোদিকে ধনীর ঘরে জন্মালে পড়াশোনায় তড়তড় করে এগিয়ে যাবে। তারমানে, সামাজিক অবস্থা ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেও ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি তার প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় দিয়ে সামাজিক বাঁধাগুলো অনেকাংশে উৎরে যেতে পারে। সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার এইটুকুকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু এটাও যে আদতে সমাজের থেকে উৎসারিত তা’ দেখিয়ে দেয়। যেমন, আমরা জানি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি উদ্যোক্তাই যাবতীয় সাফল্যের মূল। কিন্তু ম্যাক্স ওয়েবার দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তির মধ্যে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার যে গুণাবলী, সেগুলোর উৎপত্তি হয় বিশেষ একটা সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। যেসব সমাজে নির্দিষ্ট সেইসব শর্ত উপস্থিত থাকে, সেখানে কিছু কিছু ব্যক্তি পুঁজিবাদী উদ্যোক্তার গুণাবলী নিয়ে বেড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, যেসব সমাজে সেইসব শর্ত অনুপস্থিত থাকে, সেখানে কেউ পুঁজিবাদী উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনা। একইভাবে, কার্ল মার্ক্স দেখিয়েছেন কেন পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকশ্রেণী প্রতিদিন শোষিত হওয়া সত্বেও তা’ বুঝতে ব্যর্থ হয়, এবং কোন ধরণের সামাজিক অবস্থায় উপনীত হলেই কেবল তারা সেই শোষনকে অনুধাবন করতে পারে এবং ফলশ্রুতিতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। অর্থ্যাৎ, এককভাবে ব্যক্তি খুব কমই কোনকিছু নির্ধারণ করতে সক্ষম। ব্যক্তির কর্মপ্রচেষ্টায় অবধারিতভাবে নির্ধারকের ভূমিকায় চলে আসে তার সমাজ। ব্যক্তির উপর সমাজের এই ভূমিকা পাঠের বিজ্ঞানই সমাজবিজ্ঞান। 

সমাজবিজ্ঞান অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান (যথা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ইত্যাদি) থেকে স্বতন্ত্র্য এর সমাজপাঠ পদ্ধতির জন্য। এ পদ্ধতি কেমন তা’ সবথেকে সংক্ষেপে এবং সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন C Wright MIlls তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Sociological Imagination (১৯৫৯) এ। এই গ্রন্থে মিলস ‘সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে (Sociological Imagination এর আক্ষরিক নয়, বরং অর্থগত অনুবাদ) বর্ণনা করেছেন এইভাবে যে, ব্যক্তির সাফল্য ও সমস্যাকে তার সামাজিক অবস্থান এবং সেইখানে থেকে উৎসারিত সুযোগ-সুবিধা ও বাধা-বিপত্তির সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করা। অর্থ্যাৎ, ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও কর্মপ্রচেষ্টা মূলতঃ নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রক্রিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবিত।     


মিলস এই গ্রন্থে ক্লাসিক্যাল সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও প্রকাশিত বই এবং প্রবন্ধসমূহ পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে, তারা সকলেই তাদের নিজ নিজ সমাজের বিদ্যমান সমস্যাবলী নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সেইসব সমস্যার কারণ ও প্রতিকার চিহ্নিত করেছেন। এইখানে উল্লেখ্য যে, তাদের মধ্যে মতাদর্শিক পার্থক্য ছিল, এবং সেইসব পার্থক্যের দরুন সামাজিক সমস্যাসমূহের পেছনে তাদের চিহ্নিত কারণ ও প্রতিকার পদ্ধতিতেও পার্থক্য হতো। যেমন, মার্ক্স যেখানে পুঁজিপতির দ্বারা শ্রমিকের শোষণকে চিহ্নিত করেছেন শিল্পসমাজের সমস্যার উৎস হিসেবে, সেখানে ডুর্খেইমের মতে সেই উৎস হল সামাজিক সংহতির অনুপস্থিতি। ফলস্বরূপ, মার্ক্স সমাধান দিয়েছেন বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের আমূল পরিবর্তন, আর ডুর্খেইম বলেছেন সুশিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজ সংস্কার। অর্থ্যাৎ, সমাজবিজ্ঞানদের মধ্যে কোন একক মতাদর্শিক অবস্থান নেই। যা’ তাদের সকলের মধ্যে আছে, যা তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তা হলো সমাজপাঠের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। তাদের সকলে একটা বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন সমাজ গবেষণায়। সেটি কেমন? 


সমাজবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র্য গবেষণা পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন করার পদ্ধতি। মিলস তাঁর গ্রন্থের ৬ ও ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনটি প্যারাগ্রাফের মধ্যে এই পদ্ধতির প্রশ্নসমূহকে উল্লেখ করেছেন। এখানে মিলস একেক প্যারাগ্রাফে অনেকগুলো প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন বলে প্রথম দৃষ্টিতে সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি বেশ জটিল মনে হয়। কিন্তু একটু ভালোভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, সেইসব প্রশ্ন মূলতঃ সমাজের তিনটি নির্দিষ্ট দিকে নিবদ্ধ। যেমন, প্রথম প্যারাগ্রাফের চারটি প্রশ্নকে একত্রে সরল করে বলা যায় যে, যে নির্দিষ্ট সমস্যা পাঠ করতে চাই, তার সামাজিক পটভূমি কেমন? আর কিভাবে সেই সামাজিক পটভূমি উল্লিখিত সমস্যাকে প্রভাবিত করছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অবধারিতভাবেই এসে যায় কারা ক্ষমতায় আর কারা ক্ষমতার বাইরে, তাদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক কি, টার্গেটেড সমস্যার উদ্ভবে কার ভূমিকা কেমন, উক্তি সমস্যা সমাধানে কে কিরূপ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক, ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা। 

দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে মিলস সাতটি প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন। এগুলোকেও সরলভাবে একটা প্রশ্নের মধ্যে নিয়ে আসা যায় এইভাবে যে, “সমাজের বর্তমান রূপ ও কাঠামো কিভাবে তৈরি হল?- এই প্রশ্নের উত্তরে এসে পড়ে সমাজের পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং এরমধ্যে কিভাবে আলোচ্য সমস্যার জন্ম, কি কি সামাজিক ম্যাকানিজম উক্ত সমস্যাকে জন্ম দেয় এবং টিকিয়ে রাখে, উক্ত সমস্যা সমাজকে এবং ব্যক্তিকে কিভাবে প্রভাবিত করে, সমস্যার সমাধান সমাজ ও ব্যক্তির জন্য কিরূপ কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে, কিভাবে অনুরূপ সমস্যা এড়ানো যেতে পারে, ইত্যাদি আলোচনা। 


তৃতীয় প্যারাগ্রাফে মিলস পাঁচটি প্রশ্ন উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে সরল ভাবে বলা যেতে পারে এভাবে- বিদ্যমান সমাজকাঠামোয় কোন ধরণের মানুষ ক্ষমতায় আসে এবং কারা ক্ষমতায় টিকে থাকে?- এই প্রশ্ন আমাদের চিন্তা ও অনুসন্ধানকে নিয়ে যায় বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় কারা সুবিধাভোগী আর কারা বঞ্চিত, এটি কি ধরণের মানুষের জন্ম দেয়, কিভাবে তারা একে অন্যের সাথে যোগ দিয়ে একেকটা দলের অন্তর্ভূক্ত হয়, কিভাবে কিছু ব্যক্তি জাগতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি লাভ করে আর বাকিরা শৃঙ্খলিত হয়, ইত্যাদি। 


একজন সমাজবিজ্ঞানী যেকোন সামাজিক সমস্যাকে অনুধাবন (understand) করতে গিয়ে উপরে উল্লিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে। 



সমাজবিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে মূলতঃ উনিশ শতকে ইউরোপীয় সমাজ গ্রামীণ সামন্তবাদ থেকে শহুরে শিল্পসমাজে উত্তরণের প্রেক্ষিতে যেসব সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকার খোঁজার মধ্য দিয়ে। প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানীই নিজ নিজ সমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঠ করেছেন, সমাজের নানান সমস্যার উৎস চিহ্নিত করেছেন এবং সেসব থেকে প্রতিকারের পথ বাতলে দিয়েছেন। একটু ভালো করে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, মিলসের উল্লিখিত সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমাদেরকে যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বলে, সেগুলো প্রায়শঃই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে যায়। এমন হয় খুব সম্ভবত এই কারণে যে, সমাজের যাবতীয় অন্যায় শুরু এবং থিতু হয় ক্ষমতার আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে। সেইসব অন্যায়কে রুখতে গেলে তাই স্বভাবতঃই ক্ষমতাবানদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত আসে। ক্ষমতাবানরা নিজ স্বার্থের সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা করে সমস্যার মূল উৎসকে আড়াল করে রাখতে। আর সমাজবিজ্ঞান সেই আড়ালে রাখা সমস্যার প্রকৃত উৎসকে প্রকাশ করে দেয়। এইজন্যই সমাজবিজ্ঞানীর চিন্তা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীনের দৃষ্টিতে ‘অপরাধ’।  কয়েক বছর আগে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল কানাডায়। 


২০১৩ সালে আমেরিকার বোস্টনে ম্যারাথন রেসে সন্ত্রাসী বোমা হামলার প্রেক্ষিতে কানাডার তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আক্রান্তদের প্রতি সমবেদনা এবং হামলার নিন্দা জানানোর সাথে সাথে সেইসব হামলার প্রকৃত কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তার সমালোচনায় কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ষ্টেফেন হারপার বলেন যে "This is not a time to commit sociology." তিনি আরও বলেন যে, “জঙ্গিবাদের মূলে রয়েছে জঙ্গি নিজেই। আর আমরা তাই সেভাবেই এই সমস্যার মোকাবেলা করছি।” - তারমানে এইটা পরিষ্কার যে তিনি যেভাবে জঙ্গিবাদকে বুঝছেন এবং সেইমত জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করেছেন, সেইটা সমাজবিজ্ঞান সম্মত নয় । সেই সাথে তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, এইটা একটা বিশেষ সময়, যখন জঙ্গিবাদের সমস্যাকে সমাজবিজ্ঞান দিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ করা অপরাধ সংঘটনের সামিল। তিনি বলে দিয়েছেন যে, জঙ্গিবাদের উৎস জঙ্গিরা নিজেরাই। তাই তাদেরকে গ্রেফতার করলেই জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে যাবে। মোদ্দাকথা, আলোচনা শেষ। এখন শুধু বাস্তবায়ন। আর জঙ্গিবাদ নির্মূলে হারপার নিজের কর্মতৎপরতার নজির স্থাপন করেছেন দুইজন উক্ত বক্তব্যদানের সেই সপ্তাহেই “সন্দেহভাজন”কে গ্রেফতার করে। 


কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হারপারের বরাতে এইটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, জঙ্গিবাদ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার যে ন্যারাটিভ বা বয়ান চালু করেছে (অর্থ্যাৎ, জঙ্গিবাদের উৎস, জঙ্গিপন্থা অবলম্বনের কারণ, জঙ্গিবাদ প্রতিহত করার উপায়, ইত্যাদি) তা’ সমাজবিজ্ঞান সম্মত নয়। প্রকৃতপক্ষে, সেইটা সাধারণজ্ঞান সম্মতও নয়। কারণ, সামান্য মাথা খাটালেই বোঝার কথা যে, জঙ্গিবাদ হচ্ছে একটা মতাদর্শিক অবস্থান আর জঙ্গি হচ্ছে ব্যক্তি। মতাদর্শ আর ব্যক্তি এক হয় কি করে? 


মোটাদাগে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল ও বুদ্ধিজীবিদের একাংশের কাছে জঙ্গিবাদের উৎস হচ্ছে ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মাদ্রাসাগুলো। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামাতের সাথে জোট বাঁধায় তাদেরকেও জঙ্গি হিসেবে পাইকারি ভাবে ‘চিহ্নিত’ করা হয় এবং ফলস্বরূপ গ্রেফতার, ক্রস ফায়ার ও গুম করা হয়। এগুলোর সবই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, আমাদের সংবিধানের মাপকাঠিতেই। কিন্তু এই অন্যায় চলছেই। মনে হচ্ছে আরও বেশ কিছুকাল ধরে চলতেই থাকবে। কারণ, ইসলাম ধর্মকে, ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে, ইসলামভিত্তিক রাজনীতিকে জঙ্গিবাদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এরা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের বিরোধীপক্ষ। কাজেই, জঙ্গিবাদ নির্মূল করার নামে নিরাপত্তার অজুহাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনদের দ্বারা এইসব অন্যায় চলতেই থাকবে। অথচ, চট্টগ্রামের পুলিশের এসপির স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের পর দেশব্যাপী ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান’ পরিচালনা করে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে ১৫০০০ এরও অধিক বিএনপি-জামাত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করার পরেও গুলশানের 'হলি আর্টিজানে' নজিরবিহীন জঙ্গি হামলা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে একাদিক্রমে জঙ্গি সন্দেহে দাড়ি-টুপিওয়ালাদেরকে সারাদেশে দৌড়ের উপরে রাখার পরে এখন দেখা যাচ্ছে যে জঙ্গি বের হচ্ছে ক্ষমতাসীন নেতাদের ঘর থেকে, আধূনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বলিউডি নায়িকার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিষ্ট থেকে। ২০১৭ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ‘নিখোঁজ এবং সম্ভাব্য জঙ্গি’দের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তা’ থেকেও ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করার আর যুক্তিসঙ্গত উপায় নাই। একাডেমিক গবেষণাও ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জঙ্গি হামলায় জড়িতদেরকে চিহ্নিত করেছে সচ্ছল শহুরে পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক হিসেবে।


জঙ্গিবাদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সবথেকে ভয়ঙ্কর একটা সামাজিক সমস্যা। সমাজের সকল স্তরের মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত এবং এর ভয়ে ভীত। এই সমস্যার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে প্রতিদিন নানান জনে নানান রকম আলোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন, সমাধান, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছে, লেখালেখি করছে। এগুলোর মধ্যে মূলধারা মিডিয়াতে প্রকাশিত সিংহভাগই মোটাদাগে সরকারী ভাষ্য তথা ইসলাম ধর্ম জঙ্গিবাদের উৎস এবং ইসলামিষ্টরাই জঙ্গি এই বয়ানকে প্রতিষ্ঠা করছে। এর বিপরীতে আরেকটা ধারা আওয়ামী লীগ সরকারের সবকিছুই অনিবার্যভাবে ভারতপন্থি, তথা ইসলাম-বিরোধী অনুমান ধরে নিয়ে জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের দিকে ফোকাস করছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রচলিত দুই ধারাই খানিকটা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিতঃ প্রথমটির দাবী ‘ইসলামিষ্টরাই জঙ্গি’ এই অনুমান যথার্থ প্রমাণ করে এযাবৎকালের সমুদয় জঙ্গি হামলা মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায়; আর দ্বিতীয়টির দাবী ‘জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে সরকার মূলতঃ বিরোধীদলীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন’ সঠিক বলে প্রমাণিত হয় জঙ্গিবাদের নামে পাইকারি ভাবে সরকারবিরোধীদের গ্রেফতার ও শাস্তিদানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু একইসাথে সম্পূর্ন বিপরীত দুইটা অনুমান সঠিক হতে পারেনা। অর্থ্যাৎ, উল্লিখিত দুটো ধারার কোনটাই জঙ্গিবাদের মূল উৎস চিহ্নিত করা ও এর প্রতিকার বের করতে ব্যর্থ। আর তাদের এই ব্যর্থতার কারণ দলীয় বা গোষ্ঠিগত স্বার্থের বাইরে এসে নৈর্ব্যক্তিক/নির্মোহভাবে সামাজিক বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতে না-পারা। এজন্য জঙ্গিবাদের কারণ অনুসন্ধান ও এর প্রতিকার খুঁজে পেতে দরকার সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ; অর্থ্যাৎ to commit sociology। 


সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে জঙ্গিবাদের সমস্যা অনুধাবন (understand) করতে গিয়ে প্রথমেই আসবে জঙ্গিবাদে আক্রান্ত বাংলাদেশে বর্তমানে কি ধরণের সামাজিক অবস্থা বিদ্যমান, কিভাবে এই অবস্থা ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে কারা এবং এর বাইরে কারা, কিভাবে ক্ষমতার সাথে বিদ্যমান সম্পর্কে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জীবনকে প্রভাতির করছে, ইত্যাদি প্রশ্নের আলোচনা। এইসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুক্কায়িত আছে জঙ্গিবাদের সমস্যার মূল উৎস। 


এরপর খুঁজে দেখতে হবে কি কি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থার উদ্ভব হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ কিভাবে এবং কখন শুরু হয়েছে, জঙ্গিবাদের সামাজিক ম্যাকানিজম তথা কারা, কোথা থেকে, কি উপায়ে জঙ্গি হামলা করছে আর সরকারই বা কার দ্বারা, কিভাবে এবং কেন জঙ্গিবাদের মোকাবেলায় চলমান প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে, এইসব কর্মকান্ড তথা জঙ্গি হামলা এবং প্রতিকারমূলক সরকারী পদক্ষেপ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করছে, এইসব প্রশ্নের আলোচনা জঙ্গিবাদের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে সামাজিক বাস্তবতার ভিত্তিতে সঠিক জ্ঞান ও দিক নির্দেশনা দিবে। 


সবশেষে দেখতে হবে চলমান জঙ্গিবাদের সমস্যার প্রেক্ষিতে দলগতভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর কারা লাভবান হচ্ছে, কারা ক্ষমতায় আসছে এবং টিকে থাকছে আর কারা ক্রমাগত ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, ক্ষমতার সাথে সম্পর্কের এইরূপ পরিবর্তন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী/দলের মানসিকতায় কিরূপ পরিবর্তন সাধন করছে, ইত্যাদি। এইসব প্রশ্নের উত্তর জঙ্গিবাদের উৎসমূলে অবস্থান করা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে এবং তাদেরকে জঙ্গিবাদ থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া ও উপায় বাতলে দিবে। 



উপরে উল্লিখিত সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জঙ্গিবাদের সমস্যার স্বরূপ উন্মোচনকে কেন অপরাধ বলছি? এই ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদেরকে নজর দিতে হবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান আইন ও তার প্রয়োগের বাস্তবতায়। এক্ষেত্রে সংশোধিত আইসিটি এক্ট-২০১৩, আর এরসাথে পেনাল কোড ৫৪ এর প্রয়োগ উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। প্রথমোক্ত আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোন তথ্য অনুসন্ধানকারী ও প্রচারকারীকে গ্রেফতার ও শাস্তির সিস্টেম তৈরি করা আছে। আর দ্বিতীয়টি আরেক কাঠি উপরে- ৫৪ ধারা অনুযায়ী কেউ অপরাধ না করেও শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের বিরাগভাজন হয়ে ‘সন্দেহভাজন’ অপরাধী হিসেবে ধৃত, নিগৃহীত, এমনকি ক্রস ফায়ারের মধ্যে নিহত হতে পারে, হচ্ছেও প্রায় প্রতিদিন। 


জঙ্গিবাদ ও এর প্রতিকারের জন্য যে সরকারী ব্যবস্থা বর্তমান বাংলাদেশে জারি আছে, তার থেকে কমবেশি অনেক ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী নানা রকম সুবিধা পাচ্ছে। তবে সবথেকে বেশি এবং প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ। জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে বাংলাদেশ অধিকাংশ ব্যক্তিই সরকারের বা ক্ষমতাসীন কারো কাজকর্মের সমালোচনা করতে সাহস করেনা। নানান ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য অত্যন্ত কার্যকরি এক ঢাল এই জঙ্গিবাদ। অবকাঠামো উন্নয়নে নজিরবিহীন দূর্নীতি, ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যনীতি, উপর্যুপরি লুণ্ঠনে ধ্বংশপ্রায় ব্যাংকিং খাত, অদক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসা বৈদেশিক শ্রমবাজার, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে তৃণমূলে দলীয় ক্যাডারদেরকে সাংবিধানিক পদে বসিয়ে রাষ্ট্রের আপাদমস্তক দূর্বৃত্তায়ন, ইত্যাদির যেকোনটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেই তাকে বিএনপি-জামাত তথা জঙ্গি নাম দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার রাষ্ট্রীয় আয়োজন সর্বত্র দৃশ্যমান। আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে জঙ্গিবাদ ত রীতিমত শিল্পে (industry) পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের রমযানের ঈদের প্রাক্কালে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের স্ত্রী-হত্যার প্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাতে সারাদেশব্যাপী ১৫০০০ এরও অধিক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদেরকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করে পুলিশ যে ‘বাণিজ্য’ করেছে তার সঠিক হিসাব না পেলেও এইটুকু অনুমান করা যায় যে সেটা হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা থানার দারোগাদের কারো কারো পরিবারের বিলাসী জীবন লক্ষ্য করলেই এইটা বোঝা কঠিন কিছু নয়। উচ্চপদস্থদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। এহেন লাভজনক জঙ্গিবাদ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা, জঙ্গিবাদের প্রকৃত উৎস চিহ্নিত করা এবং কার্যকর প্রতিকার উদ্ভাবন করা যেহেতু ক্ষমতা এবং আইনের কারবারিদের স্বার্থের হানি করবে, অতএব এইরূপ গবেষণা ত অপরাধই! 


গবেষকরা যখন সরকারের রোষানলে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গিবাদের প্রকৃত কারণ ও সমাধান খুঁজে বের করবেন, একই সাথে আমজনতার মধ্যেও সরকারী ভাষ্যকে পরিত্যাগ করে জঙ্গিবাদ দমনের নামে গুম ও অপহরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। আর এর ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের রাজনৈতিক কর্তব্য। ব্যক্তিগত পরিসরে যেমন কাউকে আক্রান্ত হতে দেখলে প্রতিবাদ করতে হবে এবং আক্রান্তের পাশে দাঁড়াতে হবে, বৃহত্তর জাতীয় পরিসরেও সংকীর্ন দলীয় স্বার্থ পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এবং এক্ষেত্রে আমি গনচেতণার জাগরণের বিষয়ে আশাবাদী। যার একটা দৃষ্টান্ত ছিল খ্যাতিমান কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে অপহরণের পর সর্বস্তরে প্রবল প্রতিক্রিয়ার কারণে একদিনের মধ্যেই তাকে উদ্ধ্বারের ঘটনা। 


স্বাধীন বাংলাদেশ একটা আধূনিক রাষ্ট্র যেখানে সরকার নাগরিকের সমর্থন লাভ করে ব্যক্তির নানাবিধ অধিকারের স্বীকৃতি এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে। এটাই সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, আধূনিক রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি। ১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তানের জনতা স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে নেমেছিল তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র সেই চুক্তি অমান্য করে বাংলাদেশীদের অধিকার ক্ষুন্ন করেছিল বলে। মুক্তিযুদ্ধের মূল নৈতিক ভিত্তিও এখানেই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের অধিকারসমূহের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে। কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও কাজে তার প্রতিফলন না হলে সেই রাষ্ট্র আর পাকিস্তান বা বৃটিশের অধীনে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের মধ্যে আর ফারাক থাকে কোথায়? এই উপলব্ধি থেকেই আমি দাবী করি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সকল নাগরিকের অধিকারের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ - পুণ্যবান/পাপী, ঘুষখোর/সৎ আমলা ও ব্যবসায়ী, সরকারদলীয়/বিরোধীদলীয়, তথা আপামর নাগরিকের অধিকার। 


এই অবস্থান নৈতিকতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক। ভালোমন্দের বিষয় নয়, বরং লেনাদেনার। পারলৌকিক বা ধার্মিকতার নয়, বরং দৈনন্দিন। আত্মত্যাগের নয়, ব্যক্তি স্বার্থের। ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমাদের নাগরিক অধিকার আদায় করে নেওয়ার মামলা এইটা। এখানে রাষ্ট্র একপক্ষ, আরেকপক্ষ নিজ নিজ  ব্যক্তিসত্ত্বাসহ আপামর নাগরিক। রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতি জনতার আনুগত্য দাবী করে বলেই একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে আমরা অধিকার দাবী করি। নিজেদের এই অধিকার দাবী করতে গিয়ে অন্যান্য ব্যক্তির অধিকার দাবী করাকেও আমি আবশ্যক মনে করি। কারণ, রাষ্ট্রের সমস্ত আয়োজনের পাশে ব্যক্তি একাকী অতি নগণ্য, তুচ্ছ এবং তাই সহজেই নমনীয়। কিন্তু রাষ্ট্রের এই আপাতঃ বিশাল ক্ষমতার ভিত্তি আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একক ব্যক্তির সমষ্টিগত আনুগত্য। এহেন রাষ্ট্রকে কোন কিছু মেনে নিতে বাধ্য করতে হলে এর ভিত্তিকে টার্গেট করতে হবে। রাষ্ট্রও এই সত্য জানে বলে চেষ্টা করে যেন ব্যক্তির সম্মিলিত কোন বিরোধিতা দানা না-বাঁধতে পারে। ব্যক্তিবর্গের মাঝে নানাবিধ বিরোধ জারি রেখে সম্ভাব্য প্রতিরোধের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে। নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজনের উপরে আরও নতুন নতুন বিভাজন আরোপ করে ক্রমশঃ আমরা বাংলাদেশীরা রাজনৈতিক লক্ষ্যবিহীন এবং শক্তিবিহীন একটা জনতায় পরিণত হয়ে চলেছি, যারা ব্যক্তির স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলাচলের মতো একটা অধিকার আদায় করতেও অক্ষম, এমনকি এই সামান্য অধিকারটুকুর জন্য আইনের আশ্রয় নিতেও অপারগ। শুরুতে উল্লিখিত ঘটনা এই সত্যেরই দৃষ্টান্ত মাত্র।


পাঠক, আধূনিক জাতি রাষ্ট্রের নাগরিক আর পূর্বের রাজ্য/সাম্রাজ্যের প্রজার পার্থক্য উপলব্ধি করুন। আমি, আপনি বা আর কেউই কোন রাজবংশের অধীনস্ত প্রজা না। আমরা নাগরিক। ক্ষমসীন দল বা কোন ব্যক্তির কাছে আমরা দায়বদ্ধ নই, বরং তারাই আমাদের কাছে দায়বদ্ধ। কাজেই, অন্ধভাবে ক্ষমতাসীনের পক্ষ নিয়ে অপছন্দের ব্যক্তিদেরকে ‘সাইজ’ করতে গেলে আমরা মূলতঃ রাষ্ট্রের নিপীড়নের হাতকেই শক্তশালী করি, যা’ যেকোন ব্যক্তির উপরই নিপতিত হতে পারে। এজন্যই সকল ব্যক্তির অধিকারের স্বার্থেই আমাদের একাট্টা থাকা জরুরী। কারণ, আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার উপায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে।


আসুন, ধার্মিক, নীতিবান, দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল, ইত্যাদি হওয়ারও আগে স্বার্থপর হই, রাজনৈতিক হই


নিজের স্বার্থ ত পাগলেও বোঝে। তাহলে আমি, আপনি কেন নয়?


178 views0 comments

Recent Posts

See All

‘বাঙালি মুসলমানের মন’: গোঁজামিলের এক জ্ঞানবৃক্ষ

১ জাতীয় পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা আছে, আছে তার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ। মোটাদাগে, জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়...

Comentarios


bottom of page