top of page
Hasan Mahmud

সমন্বয়ধর্মী ইসলাম ও বাঙালি মুসলমান সমাজ

Updated: Jun 26, 2023





প্রায়শঃই শুনে থাকি যে, বাংলাদেশের ইসলাম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের ইসলামের থেকে আলাদা, এর সমন্বয়ী চরিত্রের কারণে। এটি বহিরাগত ধর্মমত ও চর্চার সাথে স্থানীয় ধর্মকর্মের সমন্বয়ে একটা দেশীয় চরিত্র ধারণ করেছে। এজন্য বাংলার মুসলমান মূলতঃ মডারেট মুসলমান- অথবা নামমাত্র মুসলমান- যারা ইসলামের মূল বিশ্বাস ও রীতিনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়না। ইসলামের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র্য একটা সামাজিক পরিচয় নিয়েই যারা সন্তুষ্ট। নামায-কালাম, বেহেস্ত-দোজখ ইত্যাদি নিয়ে এরা ‘অতটা সিরিয়াস’ নয়। এই বয়াণের ঐতিহাসিক ভিত্তি কি? অন্যান্য মুসলমান জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা এই মুসলমান সমাজের উৎপত্তিই বা হয়েছে কিরূপে? অসীম রায়ের The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal (1983) বইটা আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এই বইয়ে লেখক আদি ইসলামের স্বরূপ উম্মোচনের পাশাপাশি পূর্ববাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন।


বাংলাদেশের জনগণের ‘বাঙালি’ এবং ‘মুসলিম’ পরিচয়ের বিতর্ক এদেশের জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বাংলায় বৃটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনসমূহ (ফরায়েজী, তরিকতে মুহম্মদী, ইত্যাদি) থেকে শুরু করে আজকের চলমান রাজনীতি সমস্তই এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত। অসীম রায় মনে করেন যে, বাংলার আদি সমন্বয়ী ইসলাম এই বিতর্ককে সফলভাবে আত্মস্থ করেছিল বলে সেসময় "বাঙালি, নাকি মুসলিম" এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। বিশ শতকের সংস্কারবাদী ইসলামি আন্দোলনসমূহ ক্রমাগতভাবে সংস্কারপন্থী ইসলামি চেতনা ও পরিচয় প্রচার এবং সেইসাথে আদি ইসলামের মধ্যে স্থানীয় উপাদানসমূহের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন বিষোদ্গারের মাধ্যমে সমন্বয়ী ইসলাম এবং বাঙালি পরিচয়কে দূর্বল করে ফেলে। সংস্কারবাদী এইসব আন্দোলনের ফলে আদি ইসলামের স্বরূপ (তথা, অনৈসলামিক বা ‘হিন্দুয়ানী’ আচার-বিশ্বাস) উম্মোচিত হলে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একটা ‘লজ্জা’ ও ‘অপরাধবোধ’ জন্ম নেয়। তার মধ্যে ক্রমশঃ বিকশিত হয় একটা প্রখর আত্মপরিচয়বোধ। জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যায় বাংলার জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে।


অসীম রায় তার বইয়ের ভূমিকায় এই বলে শুরু করেছেন যে, বাংলায় শুধুমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠির সংখ্যাধিক্যের জন্যই নয়, বরং এদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ এবং গোষ্ঠিগত পরিচয় নিয়ে যে ভাবনা ও সংঘাত বিদ্যমান তার স্বরূপ উৎঘাটনে এ অঞ্চলে ইসলামাইজেশন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করা আবশ্যক, যা খুব কমই করা হয়েছে। তিনি এই অভিযোগ করেছেন ১৯৮৩ সালে যা’ এখনও প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। তিনি বিদ্যমান গবেষণসমূহ পর্যালোচনা করে বাংলায় ইসলামাইজেশন নিয়ে দুটি ধারা উল্লেখ করেছেন -


- একটি হলো ‘অসম্পূর্ন ধর্মান্তর প্রক্রিয়া’ যা’র মধ্য দিয়ে অনৈসলামিক মূল্যবোধ ও চর্চাসমূহ ভারতীয় ইসলামে অনুপ্রবেশ করেছে। এই ধারার মূলকথা হল- ভারতে সংখ্যাগুরু অমুসলিমদের মধ্যে দীর্ঘদিন বসবাস, ইসলামের আদিভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতা, হিন্দুদের মধ্য থেকে আধা-ধর্মান্তরিতদের সাথে বসবাস, ইত্যাদি কারণে ইসলামধর্ম মূল বিশ্বাস থেকে সড়ে গিয়ে ভারতীয় চরিত্র ধারণ করেছে।


আর দ্বিতীয় ধারাটি হলো ‘দূর্নীতি আর অধঃপতন’ যা’ বাঙালি মুসলমানকে বহিঃস্থ (তথা আরবীয় ইসলামের) মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করার ভ্রান্ত প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলার মুসলমান কখনোই আরবের মুসলমানদের মতো ছিল না। আদি মুসলমান লেখকদের সাহিত্য পর্যালোচনা করে রায় লক্ষ্য করেছেন যে, আরবি-ফারসি ভাষায় রচিত ও প্রচারিত ইসলাম ধর্ম ও সাহিত্যে প্রবেশাধিকার না থাকায় বাংলার আদি মুসলমানরা স্থানীয় অমুসলিম ঐতিহ্যের মধ্যেই রয়ে গেছে এবং সেসবের সাথে ইসলামি মূল্যবোধ ও চর্চার সমন্বয়ের মাধ্যমে সমন্বয়ী ইসলামের জন্ম দিয়েছে।


যুক্তি ও ঐতিহাসিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে অসীম রায় উল্লিখিত দুই ধারাকেই বাতিল করেছেন।



বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী উদ্ভবের সামাজিক প্রেক্ষাপট


বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম পরিচালিত ১৮৭২ সালের জনসংখ্যা গণনায় পূর্ব-বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ইংরেজদেরসহ বাংলার হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষিত অংশকে আশ্চর্যান্বিত করে। এরপূর্বে ইংরেজরা অনুমান করত যে, বাংলায় হিন্দুরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় দ্বিগুণ। অথচ, জনসংখ্যা গণনায় দেখা যায় ঠিক উল্টোটি, অর্থ্যাৎ মুসলমানরা সংখ্যায় হিন্দুদের তুলনায় অধিক।


উপরন্তু, বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক বিন্যাসও সকলকে অবাক করে দেয়। কারণ, এই মুসলিম জনগোষ্ঠী মুসলমান শাসনকেন্দ্রসমূহে নয় (যেমন, মুর্শিদাবাদ, পাণ্ডুয়া, রাজমহল, ইত্যাদি), বরং দেখা যায় সেসব থেকে দূরের পল্লী অঞ্চলে। এই ধারা ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্ন। কারণ, উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবস্থান প্রধানতঃ মুসলিম শাসনকেন্দ্রসমূহের আশেপাশে (যেমন, দিল্লী, হায়দ্রাবাদ, লক্ষনৌ, ইত্যাদি)।


মুসলমানরাও অবাক হয় একারণে যে, তারা মনে করতো বাংলার মুসলমানরা বহিরাগত মুসলিম শাসকদের সাথে বাইরে থেকে বাংলায় এসেছে। ফলে তারা সংখ্যালঘু এবং মূলতঃ নগরবাসী হওয়ার কথা। কিন্তু জনসংখ্যা গণনা মুসলমানদের সংখ্যাগুরু হিসেবে পায় পূর্ববাংলায়, তাও আবার নগর থেকে দূরের গ্রামাঞ্চলে।


একইভাবে জনসংখ্যা বিন্যাসের এই তথ্য হিন্দুদের মাঝে প্রচলিত রাজনৈতিক চাপ ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামাইজেশনের তত্ত্বকেও ভ্রান্ত প্রমাণ করে। কারণ, এই তত্ত্ব সঠিক হলে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য বাংলায় মুসলিম শাসনকেন্দ্র ও এর আশেপাশেই হওয়ার কথা। অর্থ্যাৎ, বৃটিশ বাংলায় ১৮৭২ সালের জনমিতি বাংলায় ইসলামাইজেশনের প্রচলিত ধারণাসমূহকে অকাট্যভাবে বাতিল করে দেয়।


১৮৭২ সালের জনসংখ্যা গণনার পর থেকে বৃটিশদের স্কলাররা তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রসার তত্বকে পরিত্যাগ করে এবং প্রধানতঃ নিম্নবর্গের স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরের তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করে। কিন্তু এই তত্ত্ব, বিশেষ করে স্থানীয় নিম্নবর্গ থেকে ধর্মান্তরের মাধ্যমে বাংলার মুসলমান সমাজের উদ্ভবের তত্ত্ব, তৎকালীন শিক্ষিত/মধ্যবিত্ত মুসলমানদের প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তারা একে ইংরেজদের ‘নিম্নশ্রেণী’ সামাজিক পরিচয়ের মাধ্যমে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে হেয় করার ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা নিজেদেরকে বাংলার বাইরে থেকে আগত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মুসলমান সমাজের স্থানীয় নিন্মবর্গীয় পরিচয়কে অস্বীকার করে।


কিন্তু নানান উৎস থেকে প্রাপ্ত বাস্তব তথ্য বাংলার পল্লী অঞ্চলের এই সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় নিম্নশ্রেণীর হিন্দু জনগোষ্ঠীর শারীরিক মিল নির্দেশ করে। নানান গবেষণার সূত্র উল্লেখপূর্বক অসীম রায় পূর্ব ও দক্ষিন-পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর মাঝে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী নমঃশূদ্র ও পদ, আর উত্তরবঙ্গের মুসলমানদের সাথে স্থানীয় রাজবংশী ও কোচ জনগোষ্ঠীর সাদৃশ্য ছিল বলে দাবী করেন। পরবর্তীকালে পরিচালিত বেশ কয়টি নৃতাত্ত্বিক গবেষণায়ও বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় নিম্নবর্গের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শারীরিক সাদৃশ্য নিশ্চিত করে। উপরন্তু, এই পল্লিবাসী মুসলিম ও আদিবাসী অমুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহের মাঝে প্রচলিত পোশাক-আষাক, সামাজিক উৎসব ও অনুষ্ঠানাদি, নামকরণ, ইত্যাদি আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতির সাদৃশ্য বাংলায় স্থানীয়দের ধর্মান্তরের মাধ্যমে ইসলামাইজেশনের তত্ত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বলে অসীম রায় দাবী করেছেন


সমসাময়িক বৃটিশ পণ্ডিতরা স্থানীয়দের মাঝে ধর্মান্তর, অসামরিক পদ্ধতি এবং নিম্নবর্গের ধর্মান্তর এই তিনের সমন্বয়ে বাংলায় ইসলামাইজেশনের এক নতুন তত্ত্ব জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। তাদের এই তত্ত্বের মূলকথা ছিল- উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন থেকে মুক্তির আশায় বাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাসের প্রেক্ষিতে হিন্দু ব্রাহ্মণদের হাতে বৌদ্ধদের নির্যাতনের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত অসীম রায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি দাবী করেন যে, হিন্দু-বৌদ্ধদের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তই বরং বেশি। উপরন্তু, সেসময় বাংলার কোথাও ব্যাপক আকারে বৌদ্ধ ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরের সন্দেহাতীত কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। ইংরেজদের প্রচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ইসলামে ধর্মান্তর তত্ত্বের সমর্থনে রায় দুটি যুক্তি লক্ষ্য করেন- এক, বাংলায় হিন্দুধর্ম প্রসারের প্রাথমিক পর্যায়ে এর নমনীয় ও অস্পষ্ট অবকাঠামো, এবং দুই, হিন্দু সমাজকাঠামোর অন্তঃস্থ সামাজিক নিষ্পেষণ ও অবমূল্যায়ন।


বৃটিশদের প্রচারিত তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলায় মুসলমান শাসকদের আগমনের কালে স্থানীয় জনতার উপর নৃশংস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চেপে বসেছিল ব্রাহ্মণ্য শাসন। হিন্দু শাসনাধীনে কোনরূপ ভবিষ্যৎ আশা-আকাংখ্যা না দেখে এই স্থানীয়রা মুসলমানদের শাসনকে স্বাগতম জানিয়েছিল মুক্তির সামাজিক আশায়। কিন্তু অসীম রায় ইংরেজদের প্রচারিত এই ধারণায় বেশকিছু যুক্তিগত অসামঞ্জস্য চিহ্নিত করেনঃ


প্রথমতঃ হিন্দু শাসন যদি দূর্বল ও অসংহতই থাকে, তাহলে স্থানীয়দের উপর ব্রাহ্মণদের বর্ণপ্রথার যাঁতাকল চাপিয়ে দিতে পারার কথা নয়।

দ্বিতীয়তঃ ভারতের যেসব এলাকায় ব্রাহ্মণ্যবাদ কঠোরভাবে বর্ণপ্রথা চাপিয়ে দিতে পেরেছিল (যথা উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ইত্যাদি) সেসব এলাকা কয়েকশ’ বছর মুসলমান শাসনাধীনে থাকার পরেও সেখানকার নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠিসমূহ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি।

তৃতীয়তঃ বাংলার মুসলমান সমাজেও হিন্দুদের মতো বর্ণপ্রথাভিত্তিক সামাজিক মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও সামাজিক সংগঠন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। মোটকথা, হিন্দুধর্মের বর্ণপ্রথার নিষ্পেষণ থেকে সামাজিক মুক্তিলাভের আশায় বাংলার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ইসলামধর্ম গ্রহণের তত্ত্ব অযৌক্তিক, এবং তাই অগ্রহণযোগ্য।


অর্থাৎ, এক্ষণে এটি পরিষ্কার যে, নিম্নবর্ণের স্থানীয় হিন্দু নয়, বৌদ্ধও নয়, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে বাংলার এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান গ্রামসমাজের উদ্ভব হয়েছে। পূর্ববাংলার গ্রামীণ মুসলমান সমাজ নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে এই অনুমান সঠিক হলে বাংলার স্থানীয় জনগণ ঠিক কোন সময়ে এবং কি প্রক্রিয়ায় হিন্দুত্ব বরণ করেছিল তা’ নির্ণয় করা আবশ্যক।


প্রচলিত অর্থে ধর্মান্তর বলতে বোঝায় ব্যক্তির বিদ্যমান ধর্মীয় চেতনা ও চর্চা থেকে আরেকটা নতুন ধর্মে প্রবেশ এবং সামাজিক পর্যায়ে বিদ্যমান সমাজ থেকে নতুন আরেকটি সমাজে প্রবেশ। বাংলায় ইসলামে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া খুব অল্পই ব্যক্তির ধার্মিকতাকে স্পর্শ করেছিল। এটি বরং জনগোষ্ঠীর সামাজিকতাকে বদলে দিয়েছিল, যেখানে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা নিজেদের আলাদা গোষ্ঠিগত পরিচয় নির্ণয় করতো বিবাহ, আহারাদি এবং অন্যান্য সামাজিক প্রথার আংশিক চর্চার মাধ্যমে।


ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান মিশনারীদের ধর্মপ্রচারের প্রক্রিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, এ অঞ্চলে ধর্মপ্রচারকরা মূলতঃ বিদ্যমান স্থানীয় বর্ণপ্রথাকে অটুট রেখেই নতুন ধর্ম প্রচার করত এবং নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর মাঝে খ্রিষ্টধর্মের প্রসার ঘটাত। তিনি বাংলার ইসলামাইজেশন প্রক্রিয়াতেও অনুরূপ ধারা লক্ষ্য করেছেন। আদি মুসলিম বাংলা সাহিত্যের মধ্যে অসীম রায় তৎকালীন বাংলায় ইসলামি ঐতিহ্যে বেখবর এবং উদাসীন এক বিশাল মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, পূর্ববাংলার আদি বাঙালি জনগোষ্ঠীর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর ব্যক্তিপর্যায়ে আত্মিক পরিশুদ্ধি নয়, বরং এটি ছিল উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বিদ্যমান সমাজ সংগঠন থেকে আরেকটি সমাজে প্রবেশ।


এপর্যায়ে একথা আবারও স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় যে, আমাদেরকে সন্দেহাতীত ভাবে জানতে হবে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলার স্থানীয় জনগণ হিন্দু ছিল কিনা


ব্যক্তিপর্যায়ে ইসলামধর্মে ধর্মান্তরের নানান কাহিনী প্রচলিত থাকলেও সেগুলোকে অসীম রায় বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের মাধ্যম বলে গ্রহণ করননি। এজন্য তিনি বাংলার পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক আকারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সামাজিক প্রেক্ষিতে দৃষ্টিপাত করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে স্থানীয়দের বস্তগত কোনরূপ স্বার্থ অর্জন হয়নি। বরং, উপমহাদেশের অন্যান্য এলাকার মতোই তারা ধর্মান্তরের পরেও পূর্বের মতো সমাজের নিন্মস্তরেই রয়ে গেছে। তাহলে এই ধর্মান্তরের মাধ্যমে তারা কি অর্জন করেছিল?


অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, ধর্মান্তরের মাধ্যমে এইসব নিম্নবর্গের জনগোষ্টি তাদের উপর আরোপিত ‘নিম্নবর্ণ পরিচয়’ বর্জন করে, এমনকি ক্ষমতাসীন উচ্চবর্ণের প্রতিরোধ সত্বেও। এই নতুন সামাজিক পরিচয় গ্রহণ করার পরবর্তী পর্যায়ে এরা ক্রমশঃ সামাজিক আচার-ব্যবহার ও পেশা পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে গোষ্ঠিগত সামাজিক মর্যাদা পুণর্নির্ধারণ করার প্রয়াস পেয়েছে। তারমানে অসীম রায় অনুমান করেছেন যে, সেসময় বাংলায় সমাজ উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্গে বিভক্ত ছিল এবং সেখানে উচ্চবর্ণের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু এই অনুমানের ঐতিহাসিক ভিত্তি কি? এর উত্তর পাওয়া যায় এ অঞ্চলে তার ইসলামাইজেশনের ব্যাখ্যায়। বঙ্গীয় ব-দ্বীপে ব্যাপক সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়া অনুধাবন করার জন্য অসীম রায় এই অঞ্চলের ভৌগলিক ও সামাজিক বিশেষত্বের প্রেক্ষিতে ইসলামাইজেশনকে বিবেচনা করতে হবে বলে তিনি জোর দিয়েছেন।



বঙ্গীয় ব-দ্বীপ এবং পূর্ববাংলার মুসলিম সমাজ


মধ্যযুগে বাঙলা ভৌগলিকভাবে দুটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল বলে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যার একদিকে ছিল যমুনা-পদ্মা-মেঘনার পূর্বাংশের ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল এবং মেঘনা-সুরমা উপত্যকা (মুঘলরা যাকে ‘ভাটি অঞ্চল’ বলেছে); আরেক অংশে ছিল চব্বিশপরগনা, খুলনা, সুন্দরবন, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, ও নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত মধ্য ও নিম্নগঙ্গা অববাহিকা। এই দুই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ছিল নিম্নবর্গের আলাদা আলাদা পেশাজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, যেমন- হিন্দুদের মধ্যে ছিল মহিষ্য, পদ এবং নমঃশূদ্র; আর মুসলমানদের মধ্যে শেখ ও জোলা সম্প্রদায়। ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত এইসব মানুষের মাঝে অনেক নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য বিদ্যমান ছিল তা বেশ কিছু গবেষণা নিশ্চিত করেছে।


বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে প্রকৃতির নিয়মেই পুরনো নদীপ্রবাহের অকালমৃত্যু এবং সেইসাথে অকস্মাৎ নতুন গতিধারার আবির্ভাব ঘটত। নদীর একপাড়ে ভাঙন আর অন্যপাড়ে গড়ার নিরবচ্ছিন্ন খেলায় শত বছরের পরিক্রমায় উদীয়মান উর্বর পাললিক বদ্বীপ বাংলার পশ্চিমাংশের মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ থেকে ক্রমশঃ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সড়ে আসে। (এই প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়কাল জানা আবশ্যক, যা’ অসীম রায়ের বর্ণনায় অনুপস্থিত)।

ফলশ্রুতিতে, পুরাতন ব-দ্বীপ (তথা উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ) এলাকা থেকে আদিবাসী (aboriginal) এবং অগ্রবর্তী (pioneer) কৃষিজীবি জনগোষ্ঠিসমূহ নবগঠিত পূর্বাঞ্চলীয় ব-দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের অধিকাংশ ইতোমধ্যেই তাদের মূল বাসভূমি থেকে বহিরাগত উন্নত সভ্যতার জনগোষ্ঠীদের (যথা, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান) দ্বারা বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া ভারতবর্ষের সমগ্র গাঙ্গেয় অববাহিকায়ই ছিল বলে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন, যেখানে উচ্চবর্গীয় জনগোষ্ঠীসমূহ সমাজের মূলধারায় বাস করত আর সুবিধাবঞ্চিতরা বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গলা-ডোবার ধারে কাছে বিচ্ছন্নভাবে বসবাস করত। গঙ্গার উচ্চ-অববাহিকায় এই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ছিল ভার, পাসি, চামার, দোসার, ইত্যাদি। নিম্নগঙ্গা অববাহিকার বাঙলায় তাদের সমগোত্রীয়দের ছিল মহিষ্য, পদ, নমঃশূদ্র আর শেখ জনগোষ্ঠি। অর্থ্যাৎ, বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অ-হিন্দু/বৌদ্ধ/মুসলমান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল।


বাংলার পূর্বাঞ্চলে (ভাটি বাংলায়) ক্রমবর্ধমান এই নতুন পাললিক ব-দ্বীপ বছরের অধিকাংশ সময় কয়েকফুট পানির নিচে থাকত। শেষের দিকের সেনরাজা বিশ্বরূপ সেনের সময়কার লেখনীতে এই তথ্য পাওয়া যায়, মুঘল আমলের আবুল ফজল এবং অন্যান্যরাও একই কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এমনকি ১৭১৭ সালের দিকেও ইংরেজ ভ্রমণকারীরা পূর্ববাংলার দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার কথা লিখে গেছেন। দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালী আর চট্টগ্রাম জেলা ছিল ঘনঘন জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোনে আক্রান্ত এবং প্রায়শঃই ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত। ফলস্বরূপ, এই পূর্বাঞ্চলের নতুন ব-দ্বীপের দুই অঞ্চলে বসতিস্থাপনকারী কৃষিজীবি, মৎস্যজীবী, বনবাসী, নৌকাবাসী এবং অনুরূপ অন্যান্য জনগোষ্ঠিসমূহ নিরন্তর ব্যস্ত থাকত ধ্বংসাত্মক এইসব প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে (প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও বন্যা, রোগবালাই, কুমির, বাঘ, সাপ, ইত্যাদি) টিকে থাকার লড়াইয়ে। তাদের যাপিত জীবনের কঠিন এইসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় সেসময়কার ধর্মীয় আচার-বিশ্বাসে।


অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, সময়ের পরিক্রমায় পূর্ববাংলার উর্বর ভূমিতে অগ্রবর্তী কৃষিজীবীরা জনবসতি গড়ে তুললে তা’ উন্নত সংস্কৃতির জনগোষ্ঠিসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী কিছু মানুষকে এ অঞ্চলে আসতে আগ্রহী করে তোলে। আর কে মূখার্জির বরাতে অসীম রায় দাবী করেন যে, এই শেষোক্ত বসতিস্থাপনকারীরা পূর্ববাংলায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামীণ সমাজের উদ্ভব ঘটায়। কালক্রমে তাদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সাংস্কৃতাইজেশন ঘটে এবং এখানকার সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, পুর্বমুখী বর্ধিষ্ণু ব-দ্বীপের এই নয়া কৃষিজীবি জনপদে সাংস্কৃতাইজেশন প্রক্রিয়া প্রধান নদীসমূহের গতি পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে জাতভেদমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের কেন্দ্র উত্তর ও পশ্চিম বাংলাতেই রয়ে যায়। এইজন্য বাঙলা সাহিত্যের আদি উপাদানগুলোর অবশেষ এই অঞ্চলেই পাওয়া গেছে বলে অসীম রায় মনে করেন। একই কারণেই মধ্যযুগের বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের পূণর্জাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনগুলো বঙ্গীয় ব-দ্বীপের পুরনো অংশে তথা পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল বলে তিনি দাবী করেন।


এইসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন ব-দ্বীপ তথা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমাজকাঠামো এবং সংস্কৃতি পুরনো ব-দ্বীপ তথা পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠে। অর্থ্যাৎ, পূর্ববাংলার উদীয়মান কৃষিসমাজে নয়, বরং সাংস্কৃতাইজেশন ঘটেছিল উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গেতাহলে স্বভাবতঃই জানতে ইচ্ছে হয়, সেসময় পূর্ববাংলায় কেন সাংস্কৃতাইজেশন না ঘটে ইসলামাইজেশন ঘটল? এবং কি প্রক্রিয়ায় ইসলামাইজেশন ঘটল?


নবগঠিত পূর্ব বাংলার ব-দ্বীপের বর্ধিষ্ণু সমাজকে অসীম রায় তুলনা করেছেন  ফ্রন্টিয়ার বা প্রান্ত-সমাজের সাথে, জনবসতিশূন্য কিন্তু বসবাসযোগ্য এলাকার সাথে। প্রতি বছর বন্যার পলিতে জেগে ওঠা নতুন চরে সংঘাত ও সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা এই অঞ্চলের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয়। বন্যার মধ্যে ভাঙ্গাগড়ার প্রক্রিয়ায় উত্থিত পাললিক ভূমির অধিকার ছিল এই অঞ্চলে মানুষের প্রাচুর্য ও দারিদ্র্যের নির্ধারক। যে সবথেকে বেশি ঝুঁকি নিবে, সেই সবথেকে বেশি লাভবান হবে। এহেন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানকার মানুষ গড়ে ওঠে সাহসী এবং দূর্ধর্ষ চরিত্র নিয়ে।


বন্যার পানিতে জমির সীমানা একাকার হয়ে যাওয়ায় সমাজে বিশৃংখলা আর কলহ-বিবাদ হয়ে দাঁড়ায় এই সমাজের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা। একই কারণে পূর্ববাংলায় শক্তিশালী ও সুগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা দুরূহ ছিল যা’ ইংরেজরাও লিপিবদ্ধ করে গেছে। বৈরী প্রকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতার কারণে সৃষ্ট বিশৃংখল সামাজিক অবস্থা জন্মদেয় একটা সমন্বয়ী শক্তির অভাববোধ, যে শক্তি টেকসই এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত গড়ার পথে উদীয়মান কৃষিসমাজকে নের্তৃত্ব দিবে। অতিপ্রাকৃত শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করার মাধ্যমে স্থানীয় কৃষিজীবি, মৎস্যজীবী, বনবাসী ও নৌকাবাসী জনগোষ্ঠিসমূহ একপ্রকারের মানসিক সমাধান লাভ করলেও বাস্তবিক দিকনির্দেশনা, পরামর্শ, নির্দেশ এবং নের্তৃত্বের অভাব তাদের সমাজ জীবনে থেকেই যায়। এই বিশেষ অভাববোধের বিশ্লেষণ বঙ্গীয় নতুন ব-দ্বীপে তথা পূর্ববাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সংখ্যাধিক্যের ব্যাখ্যা প্রদান করে বলে অসীম রায় দাবী করেন।


অসীম রায় উল্লেখ করেন যে, পূর্ববাংলায় ইসলামের প্রবেশ ও প্রসার ঘটেছে সাধারণভাবে পরিচিত “পীর”দের মাধ্যমে। এরা বিচ্ছিন্নভাবে এ অঞ্চলে এসে উপরোল্লিখিত সামাজিক নের্তৃত্বের অভাব দারুণ সাফল্যের সাথে পূরণ করেছিলেনপীর বলতে মূলতঃ আধ্যাত্মিক নেতা বা গুরু বোঝালেও পূর্ববাংলার এই সমাজ সূফী ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতা, মর্যাদাবান সেনানায়ক, নতুন জমিতে অগ্রবর্তী বসতিস্থাপনকারী, রূপান্তরিত হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবদেবী, এমনকি মানুষের রূপে কল্পিত অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ও আত্মা, ইত্যাদি নানান স্বত্বাকে পীর হিসেবে গ্রহণ করতো। বাঙালি মুসলমান সমাজ পীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত এইসব স্বত্বাকে ঘিরে এক প্রকার লৌকিকধর্ম গড়ে তোলে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে এদের মুখাপেক্ষী হয়। এজন্যই পূর্ববাংলার আনাচে-কানাচে পীরদের অস্তিত্বের নিদর্শন দেখা যায় বলে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন।


পীরের কবর জিয়ারত বা সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠা বাংলার বাইরে আরও অনেক অঞ্চলে দেখা গেলেও বাংলায় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বাইরেও উল্লিখিত নানান রকম স্বত্বার উপর পীরত্ব আরোপ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। যুগের পর যুগ নানান অস্তিত্বের প্রতি আনুগত্য ও উপাসনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে এক ধরণের ধর্মীয় রূপান্তর ঘটে যাকে অসীম রায় বলেছেন পীরিফিকেশন। এজন্য পীরিফিকেশনকে তিনি বাংলায় ইসলামাইজেশনের পাঠে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র বলে উল্লেখ করেছেন। শুরু থেকে উনিশ শতক অব্দি যেসকল পীরের হদিস পাওয়া যায়, তাদেরকে অসীম রায় প্রথমে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন-

ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রসিদ্ধ পীর (যথা, হয়রত শাহ জালাল) এবং

কল্পিত ও অবাস্তব পীর (যথা দক্ষিণ রায়, গাজী কালু খাঁ, প্রমুখ)।


এসব পীরের মধ্যে অনেকে প্রধানতঃ আধ্যাত্মিক গুরু বা ধর্ম প্রচারক ও নেতা হিসেবে সুপরিচিত হলেও অনেক পীর ছিলেন যারা আধ্যাত্মিকতা নয় বরং বাস্তব জীবনের নানান পরিস্থিতিতে নের্তৃত্বদানের মাধ্যমে সময়ের পরিক্রমায় পীরের আসন লাভ করেছিলেন।


উদীয়মান এইসব অস্থির ও সংঘাতময় সমাজে অত্যন্ত সফল নের্তৃত্বদানের মাধ্যমে কিছু দুঃসাহসী ও অগ্রবর্তী কিছু মুসলমান জলা-জঙ্গলার মধ্য থেকে কৃষিজমি বিস্তারের পাশাপাশি সামাজিক শৃংখলা, কর্তৃত্ব ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ স্থানীয় জনতা তাদেরকে পীরের স্বীকৃতি দান করে বলে অসীম রায় দাবী করেন। এই প্রক্রিয়ার উদাহরণ হিসেবে তিনি খুলনা অঞ্চলের প্রসিদ্ধ পীর খান জাহান আলী এবং নোয়াখালীর পীর উমর শাহের উল্লেখ করেন। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বনজঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদি জমি উদ্ধার ও কৃষিসমাজ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় নের্তৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে অনেকে পীরত্ব অর্জন করেছিলেন। এই অগ্রবর্তী কৃষীজীবি জনতা কারা? তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাই বা কিরূপ ছিল যা’ তাদেরকে সাফল্যের সাথে নতুন নতুন কৃষিজমি আবিস্কার/বিস্তার ও আবাদ সম্প্রসারণ সম্ভব করেছিল?


উল্লিখিতদের ছাড়াও স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনই তাদের নিজ নিজ বিপদসংকুল কর্মক্ষেত্রে (যথা জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, ইত্যাদি) বাধাবিপত্তির মোকাবেলায় নানান বাস্তব ও কল্পিত শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করে তাদের পূজা দিত এবং তাদের কাছ সাহায্য প্রার্থনা করত বলে অসীম রায় লক্ষ্য করেছেন। যেমন, কোন এলাকার হিন্দু ও মুসলিম কাঠুরেরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ‘ফকির’কে সাথে নিয়ে নৌকাযোগে কর্মক্ষেত্রে যেত। তারা বিশ্বাস করত যে, এই ফকির ডাঙ্গার বাঘ আর নদীর কুমিরকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখত। সিলেট, ময়মনসিংহ ও খুলনাসহ পূর্ববাংলার প্রত্যেক জেলায় এবং প্রত্যেক অঞ্চলে এমন একজন করে পীর ছিল বলে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন। সবশেষে তিনি আরেক প্রকারের পীরের উল্লেখ করেছেন যারা স্থানীয় জনতার কাছে বিজেতা এবং আত্মত্যাগী শহীদ হিসেবে সম্মানিত, যেমন জাফর খান গাজী, শাহ ইসমাইল গাজী, বাবা আদম শহীদ, প্রমুখ।


বিশেষ ব্যক্তিকে পীর হিসেবে বরণ করার পাশাপাশি স্থানীয় জনতা পীরদের কর্মক্ষেত্রে খানকাহ (আশ্রম/আখড়া) আর তাদের মৃত্যুর পর কবরের উপর দরগাহ বা মাজার গড়ে তোলে। অসীম রায় এগুলোকে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় সমাজের স্নায়ু-কেন্দ্র হিসেবে। সমগ্র পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এইসব খানকাহ ও মাজার স্থানীয় নিম্নবর্ণ ও অচ্ছুৎ জনগোষ্ঠীর জাগতিক, ধর্মীয় ও মানসিক নানাবিধ চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। স্থানীয় মন্দির বা ব্রাহ্মণের কাছে এসব জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার না থাকায় উল্লিখিত দুই মুসলিম প্রতিষ্ঠান সহজেই তাদেরকে আকর্ষন করে।


এছাড়া মধ্যযুগের যাজ্ঞিক-তান্ত্রিক ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর নির্জন সাধনা উদীয়মান সমাজে ব্যক্তিপর্যায়ের সহজ-সরল বাস্তব ও মানসিক চাহিদা বুঝতে অপারগ হওয়ায় তারা পীর ও তার খানকাহ/মাজারের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় জনগণের এইসব চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পূরণে এগিয়ে আসে। এজন্য এইসব প্রতিষ্ঠান সরকারি পৃষ্টপোষোকতা এবং সহায়তাও লাভ করত বলে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন।


তবে এইখানে পীরদের আবির্ভাবের কালে মন্দির আসল কিভাবে এবং কখন তার কোন ব্যাখ্যা নেই অসীম রায়ের কাছে। একইভাবে, যাজ্ঞিক-তান্ত্রিকরাই বা আসল কখন ও কিভাবে? তিনি সম্ভবতঃ অনুমান করেছেন যে এখানে আগে থেকেই মন্দির তথা হিন্দু এবং তান্ত্রিকরা ছিল যা’ তারই উল্লিখিত ফ্রন্টিয়ার বা প্রান্ত-সমাজের অনুমানের সাথে সাংঘর্ষিক


আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, মুসলমান সমাজের তৃণমূলে মসজিদ থাকার কথা। কারণ, মসজিদ মুসলমান সমাজের অবিচ্ছেদ্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আদি বাঙালি মুসলমান সমাজে অসীম রায় কোন মসজিদ লক্ষ্য করেননি।



সাংস্কৃতিক দুতিয়ালদের আবির্ভাবের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ইসলামের সমন্বয়ী ঐতিহ্য


পূর্ববাংলায় ইসলামাইজেশনের গতি ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছিল এ অঞ্চলের স্থানীয় ও নিম্নবর্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা দ্বারা। এই প্রক্রিয়া এবং এর প্রভাবকসমূহ আবিষ্কারের জন্য অসীম রায় মুসলমানদের রচিত আদি বাংলা সাহিত্যের পাণ্ডুলিপিগুলো পাঠ করেছেন। তিনি দেখেছেন যে, আরবি-ফার্সী ভাষায় জ্ঞান না থাকার জন্য বাঙালি মুসলমান প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল বলে সেইসব মুসলমান রচয়িতাগণ তাদেরকে প্রকৃত ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার সামাজিক দায়বোধ করেছিলেন।


ইসলামের পবিত্র পুস্তকাদি স্থানীয় অপবিত্র ভাষায় (তথা বাংলা ভাষায়) ভাষান্তর করা ‘পাপ’ জানা সত্বেও তারা সেগুলোকে স্থানীয় মুসলমানদের পাঠোপযোগী করে বাংলায় অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি সেসময়কার বাঙালি মুসলিম সমাজের আরও একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন- উঁচু ও নিচু ভেদাভেদ।


ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের অনুরূপ বাংলাতেও মুসলিম সমাজ মূলতঃ বহিরাগত এবং স্থানীয় এই দুইভাগে বিভক্ত ছিল যেখানে বহিরাগতরা সমাজের উঁচু শ্রেণী এবং স্থানীয় ধর্মান্তরিতরা নিচুশ্রেণীতে অবস্থান করত। এই দুই শ্রেণী একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও সতন্ত্র্য অবস্থান বজায় রাখত। ১৯০১ সালের সরকারী জনসংখ্যা গনণায় প্রথমোক্তদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘আশরাফ’ (বা শরীফ) হিসেবে যারা ছিল সম্ভ্রান্ত এবং সন্দেহাতীত ভাবে বহিরাগত অথবা উচ্চবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত। আর শেষোক্তদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘আরজাল’ বা নিচুজাত হিসেবে। পরবর্তীতে এটি বাংলায় খানিকটা বিকৃত হয়ে ‘আতরাফ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অসীম রায়ের মতে ইতিহাস, কল্পকাহিনী এবং অজ্ঞতা বাঙালি মুসলিম সমাজের উল্লিখিত উঁচু-নিচু বিভক্তি ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।


অধ্যাপক একে নাজমূল করীমের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা) উদ্ধৃতি দিয়ে অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, আরবে ইসলাম সামাজিক মর্যাদার নতুন এক মাপকাঠি প্রতিষ্ঠা করে যেখানে নবীর সাথে রক্ত ও বিশ্বাসের নৈকট্য উচ্চ সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করত। একই ধারা পূর্ববাংলার উদীয়মান বাঙালি মুসলিম সমাজের মধ্যেও চলে আসে- ইসলামের নবীর সাথে এমনকি দূরবর্তী কোনরূপ সম্পর্ক থাকলেও তা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দান করত। আর এটা ত সহজবোধ্য যে, নবীর সাথে এই নৈকট্যের সম্ভাব্য দাবিদার হতে হলে আরব থেকে, নিদেনপক্ষে বাংলার বাইরে থেকে আসতেই হবে।


অতএব, যেসব মুসলমান তাদের বংশধারা নবীর সাথে সম্পর্কিত বলে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল, তারা সৈয়দ নামে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পেল সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ স্থান; এরপর যারা ইয়েমেন, ইরাক, পারস্য, ইত্যাদি অঞ্চল থেকে আগমনের দাবী প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে পাঠান, মুঘল, শাহ, মীর, ইত্যাদি বংশপদবী গ্রহণ করল, এবং সবশেষ অবস্থান হলো স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতাবানরা সামন্তশ্রেণী, যথা রাজা, জমিদার, তালুকদার, জোতদার, চৌধুরী, প্রমুখ। মজার ব্যাপার হলো, বাংলায় বহিরাগতদের উচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তির প্রথাটি হিন্দুদের মধ্যেও দেখ যায় বলে অসীম রায় মনে করেন। (সম্ভবতঃ তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজত্বকালে বহিরাগত কুলীন ব্রাহ্মণ আর স্থানীয় বাঙালি বামুণদের মধ্যে বিদ্যমান মর্যাদার পার্থক্য থেকে এই অনুমান করে থাকবেন।)


বহিরাগত এবং অ-ভারতীয় বংশ পরিচয় উচ্চ সামাজিক মর্যাদার নির্ধারক হওয়ার কারণে তৎকালীন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অনুরূপ বংশ-ইতিহাস আবিষ্কারের একটা প্রবণতা ছিল। বিভিন্ন গবেষকের উদ্ধৃতি ছাড়াও ১৮৮২ এবং ১৯০১ সালের সরকারি জনসংখ্যা গনণায় জেলাভিত্তিক বংশবিন্যাসের পরিসংখ্যানে এই বংশমর্যাদার অতিরঞ্জন সুস্পষ্ট। যেমন ১৯০১ সালে নোয়াখালী জেলায় সর্বমোট ৮৬৫,৭০৯ জন মুসলমানের মধ্যে ৮৬২,২৯০ জনই নিজেদেরকে বহিরাগত বলে দাবী করেছিল। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে, এদের অধিকাংশই নোয়াখালীর বাইরে থেকে এসেছিল, কিন্তু সেটা অবশ্যই ৯৯% ভাগ হতে পারেনা, আরব থেকে ত নয়ই। এই অতিরঞ্জনের প্রবণতা এতোটাই বেশি প্রচলিত হয়ে পড়েছিল এবং এই দাবীর অসারত্ব এতোটাই স্থূলভাবে প্রকট ছিল যে, এটি তৎকালীন সমাজে উপহাস-বিদ্রুপের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। যেমন, শুরুতে ছিল উল্লা/তুল্লা, পরে হলো উদ্দিন। পরবর্তীতে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটলে নামের শেষের মামুদ চলে আসে প্রথমে


একটি কাল্পনিক নাম দিয়ে অসীম রায় এই প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- শুরুতে মেহেরউল্লা থেকে মেহেরউদ্দিন মুহাম্মদ হয়ে সবশেষে মুহাম্মদ মেহেরউদ্দিন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নামের এইরূপ ক্রমবিবর্তন সম্ভব হতো ধনসম্পদ, জমিজমা আর নানারকম জমিদারী পদবী থাকলে। অর্থাৎ, উচ্চ সামাজিক মর্যাদা প্রকৃতপক্ষে সঠিক বংশধারা নয়, বরং ধনে-মানে-প্রতিপত্তিতে উচ্চ সামাজিক অবস্থানের পরিচায়ক ছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজের এই আশরাফ-আতরাফ বিভক্তির মাধ্যমে অসীম রায় দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কি প্রক্রিয়ায় বাঙালি মুসলমান শুধুই মুসলমান আর বাঙালি হিন্দু শুধুই বাঙালি হয়েছিল, সেইসাথে কিভাবে বাংলাভাষা হিন্দুয়ানী ভাষায় পরিণত হয়েছিল।


তিনি উল্লেখ করেন যে, অভিজাত মুসলমানরা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দাবী করত নিজেদের বহিরাগত পরিচয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য বাঙালি মুসলমানরাও নিজেদের স্থানীয় পরিচয়কে অস্বীকার করে বহিরাগত বা ‘মুসলমান’ হিসেবে পরিচয় দিত। ফলে, বাঙালি পরিচয় শুধুমাত্র অ-মুসলমান তথা হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে পরিণত হয়। যেমন, বাঙালি পাড়া বলতে সেসময় বোঝাতো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বসতি। পক্ষান্তরে মুসলমান অধ্যুষিত বসতির নাম হতো মুসলমান পাড়া। আর এ’ থেকেই এই ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাংলা ভাষা ‘হিন্দুয়ানী’ ভাষা। অতএব, এটি খাঁটি মুসলমানের জন্য উপযুক্ত নয়, ইসলাম ধর্ম-কর্মের জন্য ত নয়ই। মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য ভাষা ছিল- বংশমর্যাদার মতই - আরবি, ফারসি এবং আরও পরে উদূ তথা বহিরাগত ভাষা। কোন কোন মুসলমান সুলতান যে বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বলে জানা যায়, তা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা রচিত হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত বিষয়াদিতে।


মোটকথা, অভিজাতদের প্রভাবে বাঙালি মুসলমান বাংলার স্থানীয় তথা বাংলাভাষাকে নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছিল বলে অসীম রায় দাবী করেন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, বহিরাগত ভাষার সাথে স্থানীয় ভাষার তুলনা করতে গিয়ে অসীম রায়ের স্থানীয় ভাষা হিসেবে বাংলাভাষাকে উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, বাংলা কখন ও কিভাবে স্থানীয় জনগণের ভাষা হয়ে উঠেছিল?


বাংলা ভাষাকে নিয়ে মুসলমান অভিজাত আর সাধারণের মাঝে যে বিভেদ দেখা যায়, তা’ আসলে বাঙালি সংস্কৃতিতে বহমান একটা গভীর ফাটলেরই বহিঃপ্রকাশ বলে অসীম রায় মনে করেন। তিনি প্রাক-মুসলিম বাঙলার সংস্কৃতিকে কে ব্যাখ্যা করার জন্য একে প্রধান ঐতিহ্য (Great traditions) এবং প্রান্তিক ঐতিহ্য (Little Traditions) এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। তিনি হিন্দুইজম, যাজ্ঞিক-তান্ত্রিক নাথ পন্থা এবং সহজিয়া সম্প্রদায়সমূহকে প্রথমোক্ত শ্রেণীতে আর নানান স্থানীয় পুজা-উপাসনাকে শেষোক্ত শ্রেণীভুক্ত করেছেন। তিনি দাবী করেন যে, এই দুই ধরণের ধর্মীয় ঐতিহ্যসমূহ আবহমানকাল ধরে বাংলায় ইসলামের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত একে অপরের সাথে মিলেমিশে অবস্থান করেছে। শ্রেণী বিভক্ত এবং বহির্মুখী সুন্নি ইসলাম বাঙলার এই সহাবস্থানমূলক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ধারাবাহিকতায় ভাঙ্গন ধরায়। মুসলমান সমাজে অভিজাতদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রধান্যের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই বিভক্তি আরও বৃদ্ধি পায় এবং ভাষাগত বর্ণবৈষম্যের (linguistic apartheid) দ্বারা সুসংহত হয়।


বাঙালি মুসলিম সমাজে অভিজাত আর আমজনতার মাঝে বিদ্যমান এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব সমগ্র সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। অসীম রায় উল্লেখ করেন যে, এই হুমকিটা ছিল মুসলিম অভিজাতদের থেকে বিচ্ছিন্ন এই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর কালক্রমে হিন্দুত্বের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এই বিপদ সম্পর্কে বাঙালি অভিজাত মুসলমান সচেতন হয়ে ওঠে ১৯শতকের শেষার্ধে এসে। ফলশ্রুতিতে তারা বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান এবং প্রান্তিক ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে, ইসলাম এবং স্থানীয় ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে সম্মিলন ঘটানোর লক্ষ্যে নানান বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস পায়। এই প্রেক্ষিতে ১৬শতক থেকে ১৯শতক সময়কালে বাঙালি মুসলমান সমাজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংস্কৃতিক দুতিয়ালের আবির্ভাব ঘটে যারা ইসলামকে বাঙালি মুসলমানের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হয়। রায়ের বর্ণনার এইখানে এসে সবথেকে বড় হোঁচট খেতে হয়।


অসিম রায়ের উল্লিখিত আদি ইসলাম ছিল সমন্বয়ী চরিত্রের, যা’ ১৯ আর ২০ শতকে এসে সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রভাবে পরিবর্তীত হয়ে সাম্প্রদায়িক রূপ পরিগ্রহ করে। আর এখানে তিনি বলছেন যে, মুসলমান অভিজাতরা সমন্বয়ের প্রয়োজনবোধ করে ১৯ শতকে এসে। এই দুই অনুমান স্পষ্টভাবেই সাংঘর্ষিক


অসীম রায় উল্লেখ করেছেন যে, এইসব সাংস্কৃতিক দুতিয়াল এসেছিল বহিরাগত এবং স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমান পরিবার থেকে। কিন্তু বহিরাগত তথা আশরাফ পরিবার থেকে আসলেও তারা অভিজাত বাঙালি মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়েছিল উচ্চশ্রেনীতে থাকার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সংগতির অভাবে, এবং প্রধানতঃ অভিজাত শ্রেণীর মধ্যকার সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা/বর্ণবাদ থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু এই অনুমানকে আবার তারই পরবর্তী পর্যবেক্ষণ বাতিল করে যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পেশাগত ভাবে এইসব দুতিয়ালদের মাঝে কেউ কেউ ছিল পীর, আবার অনেকে ছিল স্থানীয় পর্যায়ে ধর্মীয় ও সেক্যুলার পদাধিকারী। প্রথমোক্তদের মধ্যে সৈয়দ সুলতান আর শেষোক্তদের মধ্যে শাহ মুহম্মদ সগীরে নাম বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। কিন্তু এখানেও আশরাফ বা অভিজাত পরিবার থেকে আসা দুতিয়ালদের সম্পর্কে অসীম রায়ের অনুমান স্ববিরোধী। কারণ, ধর্মীয় ও সেক্যুলার পদাধিকারীদের আর্থিক সঙ্গতি এবং আভিজাত্যের অভাব অবাস্তব।



বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার পর্যালোচনা


বাঙলা সাহিত্যের সূচনাপর্বে এসব দুতিয়ালদের লেখার মধ্যে একটা জোরালো আঞ্চলিকতা লক্ষ্যনীয়। সামাজিক অবস্থানে নানারূপ পার্থক্য থাকা সত্বেও অসীম রায় এদের মধ্যে তিনটি মিল খুঁজে পেয়েছেনঃ

এক, সহধর্মী জনতার মাঝে (তথা, বাঙালি মুসলমান সমাজে) ইসলামী জ্ঞান ও ঐতিহ্যের প্রচার,

দুই, ভাষাগত দূরত্বের কারণে (তথা, আরবি-ফারসীতে লিখিত ইসলামী বইপত্র পাঠে অপারগতা) মুসলমান সমাজের নানান অজ্ঞতা ও অনাচার দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়াস, এবং

তিন, অভিজাত মুসলমানদের বহিরাগত সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ ও বাঙলা ভাষাকে স্থানীয় মুসলমানদের জন্য সাংস্কৃতিক মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ। এদের মধ্যে বিশেষ করে পীর-লেখকরা বাংলায় ইসলাম-সম্পর্কিত লেখালেখিকে এমনকি তাদের ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেন।


মুসলমান সমাজের অভিজাত ও আমজনতার মাঝে ওঠাবসার অনুপস্থিতি এবং সেইসাথে বহিরাগত বৃহৎ সংস্কৃতি (তথা ইসলাম) ও স্থানীয় প্রান্তিক (তথা, স্থানীয় অ-হিন্দু/বৌদ্ধ/তান্ত্রিক) সংস্কৃতির মধ্যে লেনাদেনার অভাব এইসব সাংস্কৃতিক দূতিয়ালদের সবথেকে বেশি ভাবিত করেছিল বলে অসীম রায় দাবী করেন। এজন্যই তিনি লক্ষ্য করেন যে, সৈয়দ সুলতানের মতো জনপ্রিয় ধর্মীয় নেতারা মুসলমান সমাজের অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং সমাজের ভাঙ্গন রোধে সচেষ্ট হন। এইসব সাংস্কৃতিক দুতিয়ালদের প্রভাবে বাঙালি মুসলমান সমাজের মাঝে বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে সাহিত্য রচনার আহবান ডাক যা’ পরবর্তি কয়েক শতাব্দী ধরে চলে। এই সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি মুসলমানকে সঠিক ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এদের হাতে বাংলাভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এইসকল মুসলমান রচয়িতারা আরবি এবং ফার্সিকেই অধিক মর্যাদাবান মনে করেছেন। এমনকি বাঙলাভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে চরম অবস্থান নেওয়া কবি আব্দুল হাকিমও বলে গেছেনঃ "আরবি শিক্ষা সর্বোত্তম। আরবি শিখতে না পারলে উত্তম জ্ঞান লাভের নিমিত্তে ফার্সি শেখো। সেটাও না পারলে তোমাকে অবশ্যই নিজের ভাষা শিক্ষা করতে হবে"।


মজার ব্যাপার হলো, বাঙলা ভাষার প্রতি মুসলমান অভিজাতদের অনীহা অসীম রায় হিন্দু অভিজাত তথা ব্রাহ্মণদের মধ্যেও লক্ষ্য করেছেন। হিন্দুইজম তথা বহিরাগত বৃহৎ সংস্কৃতির ধারকরা বাংলায় এসে সাংস্কৃতাইজেশনের মাধ্যমে প্রাধান্য লাভ করলে পর ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত ভাষাকে বলত ‘দেবভাষা’ আর স্থানীয় ভাষাকে বলত দেশি-ভাষা, লোক-ভাষা, লৌকিক-ভাষা, প্রাকৃতভাষা, ইত্যাদি। এমনকি উনিশ শতকে এসেও সংস্কৃত পণ্ডিতরা বাঙলাকে বলতো ‘গৌড়ীয় ভাষা’। ১৬ এবং ১৭ শতকের আদি মুসলমান সাহিত্যিকরাও (যথা সৈয়দ সুলতান এবং আব্দুল হাকিম) বাঙলা ভাষাকে বলতেন ‘বঙ্গভাষা’, ‘বঙ্গবাণী’, ইত্যাদি। উপরন্তু, হিন্দু পণ্ডিতরা মুসলমান অভিজাতদের মতই স্থানীয় ভাষাকে হিন্দু শাস্ত্রের জন্য অনুপযুক্ত মনে করত। আদি মুসলমান সাহিত্যিকদের মতোই হিন্দু সাংস্কৃতিক দুতিয়ালরাও ‘দেবভাষা’ তথা সংস্কৃত ভাষার স্থলে স্থানীয় ভাষায় পৌরাণিক দেবদেবীদের কাহিনী লেখার জন্য পাপবোধে ভুগেছেন এবং কৈফিয়ত হিসেবে স্থানীয় হিন্দু জনতার সংস্কৃত ভাষাজ্ঞানের অভাবকে উল্লেখ করে গেছেন, যা’ ১৬ শতকের কবি মাধব আচার্য্য, রামচন্দ্র খান, কবি শেখর, প্রমুখ হিন্দু কবির রচনায় উল্লেখ আছে।


এখানে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু-মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউই স্থানীয় ভাষা হিসেবে বাঙলার কথা উল্লেখ করেননি। অর্থ্যাৎ, অভিজাত মুসলমানদের এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু পণ্ডিতদের মধ্যে যে বাঙলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষ, তা’ মূলতঃ বাংলার স্থানীয় অ-হিন্দু/মুসলমান জনগণের ভাষার প্রতি এবং এর উৎপত্তি বাঙলাভাষার জন্মেরও আগে সাংস্কৃতাইজেশন আর ইসলামাইজেশনের প্রক্রিয়ায়


অসীম রায় দাবী করেছেন যে, ইসলাম ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে বাঙলা ভাষায় সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে মুসলমান সাংস্কৃতিক দুতিয়ালরা ইসলামকে আরবি-ফার্সি না-জানা বাঙালি মুসলমান সমাজের কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেটা ছিল কেবলমাত্র একটা প্রাথমিক বাঁধা অতিক্রম করা। কারণ, শুধুমাত্র বাঙলা ভাষা বাঙালি মুসলমান সমাজকে ইসলাম ধর্মের মধ্যে নিয়ে আসতে (অথবা ইসলামকে বাঙালি সমাজে নিয়ে আসতে) সমর্থ ছিলনা। বাঙালি মুসলমানের কাছে ইসলাম ধর্ম ছিল কতিপয় মৌলিক বিশ্বাস ও আচারের সমষ্টিমাত্র, যার প্রতি তাদের কোন প্রকার আবেগ-অনুভূতির যোগসূত্র ছিল না। ইতিহাস, কল্পকাহিনী, বিশ্বাস, সংস্কার, অতিপ্রাকৃত শক্তি ও আত্মায় বিশ্বাসে ভরপুর বাঙালি সমাজের বেশিরভাগ ধার্মিকতা পূরণে আদি ইসলাম অসমর্থ ছিল।


বাংলা ভাষায় ইসলামী বিষয়াদি নিয়ে রচিত সাহিত্য বাঙালি মুসলমানকে একটা নতুন আত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্য হতে নৈতিকতার ভিতি প্রদান করলেও তাদের প্রয়োজন ছিল আরও বেশি। তাদের দরকার ছিল একটা ধর্ম, যা তাদের সমস্ত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও আচার-ব্যবহারকে ধারণ করবে। আর সব লৌকিক সমাজের মতো বাঙালি সমাজের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা অন্বেষণ করত অতিপ্রাকৃত শক্তির অবিনশ্বরতা, ধার্মিকতা ও দেবত্বের। এজন্য তাদের ধর্মের সত্যাসত্য নির্ভর করত তাদের বীরদের অতিমানবিক ও অতিপ্রাকৃতিক স্বত্বায় উত্তরণের মধ্য দিয়ে, ধর্মতত্ত্ব বা বিমূর্ত তর্কে-বিতর্কে নয়। আদি ইসলাম এইক্ষেত্রে, অর্থ্যাৎ বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্য বীরগাঁথা প্রদানে পুরোপুরি অপারগ। কারণ, ইসলাম ধর্মের সমস্ত বীর ও তাদের আখ্যান আরবি-ফার্সি ভাষায় রচিত হওয়ায় সেগুলো ছিল বাঙালি মুসলমানের কাছে অধরা। অথচ, সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল টুইটম্বুর ছিল রামায়ণ ও মহাভারতের ঐতিহ্য, নাথপন্থা আর মঙ্গলকাব্যের নানান চরিত্র যথা মনসা, চণ্ডী, ধর্ম, শিব, এবং আরও বিবিধ ক্ষুদ্র ধর্মীয় ঐতিহ্যে।


উদীয়মান বাঙালি মুসলমান সমাজের পক্ষে একটা সাংস্কৃতিক শূন্যতার মাঝে বাস করা সম্ভব ছিলনা। তারা আগে থেকেই তাদের মধ্যে মজুদ বাংলা পালাগান, লোকসাহিত্য, ধর্মীয় ও রহস্যপখ্যানের অফুরন্ত ভাণ্ডারকে আঁকড়ে রাখে। একারণে আরবি ও ফার্সি ভাষা থেকে ইসলামকে কেবলমাত্র বাংলাভাষায় ভাষান্তর করাই যথেষ্ঠ ছিল না। ইসলামের ঐতিহ্যকে বাঙালির পরিচিত কাঠামোর মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা জরুরী হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, মুসলমান দুতিয়ালদের জন্য মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় ইসলামের রক্ষণশীল ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে বাংলার স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে রুপায়ন করা। তাদের সাহিত্যকর্মের মধ্যদিয়ে ঠিক এই দায়িত্বই তারা পালন করেছিলেন বলে অসীম রায় দাবী করেন।



সিদ্ধান্ত/উপসংহার


পূর্ববাংলার বাঙালি সমাজের আবির্ভাব হয়েছিল অপেক্ষাকৃত নতুন ব-দ্বীপ অঞ্চলে। এই অঞ্চল গড়ে উঠেছিল প্রধান নদীসমূহের প্রবাহ পশ্চিম থেকে ক্রমশঃ পূর্ব দিকে সড়ে আসার ফলে। এই অঞ্চলে ইসলামাইজেশন হয়েছিল, আর পুরাতন ব-দ্বীপ তথা উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গে হয়েছিল সাংস্কৃতাইজেশন। ফলশ্রুতিতে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামীণ কৃষিসমাজের জন্ম দেয়। অসীম রায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, পূর্ববাংলার আদিবাসী নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় ‘পীর’দের মাধ্যমে। তিনি উল্লেখ করেছেন করেছেন যে, স্থানীয় উদীয়মান কৃষিসমাজে ‘দিকনির্দেশনা, পরামর্শ, নির্দেশ এবং নের্তৃত্বের অভাব’ ছিল, যার ফলে তারা পীরদের দ্বারস্থ হয় এবং ক্রমান্বয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। কিন্তু তিনি আবার এও উল্লেখ করেছেন যে, তাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল হিন্দুইজম, বুদ্ধিজম, নাথপন্থা, যজ্ঞ, ইত্যাদির মত ‘বৃহৎ’ ঐতিহ্য এবং নিজেদের নানান ক্ষুদ্র ঐতিহ্য। তারা সেগুলোকে ত্যাগ করে কেন মুসলমান পীরদের দ্বারস্থ হয়েছিল? তারা হিন্দু নিম্নবর্ণের হয়ে থাকলে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হিন্দু ধর্মীয় ও সামাজিক নের্তৃত্বের কাছেই ত যাওয়ার কথা।


তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে, পূর্ববাংলার স্থানীয় জনতা তাদের নিম্নবর্ণের সামাজিক পরিচয় পরিত্যাগ করার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তিনিই আবার উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামে ধর্মান্তরের পরেও তারা সমাজের নিম্নস্তরেই অবস্থান করত। তারমানে, সামাজিক মর্যাদা নয়, অন্যকিছু তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেটা কি?


বাংলার ইসলামাইজেশন পাঠে অসীম রায়ের সবথেকে বড় অবদান হলো এই যে, তিনি সুনির্দিষ্ট করে পীরিফিকেশনকে চিহ্নিত করেছেন পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ পল্লীসমাজের ইসলামে ধর্মান্তরের সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে। অর্থ্যাৎ, পূর্ববাংলার আনাচে-কানাচে এই যে পীরদের নিদর্শন দেখা যায়, তাদের উদ্ভব ও বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার মুসলমান সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ অনুসন্ধান করা সম্ভব। তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে, সেটা ছিল নতুন নবগঠিত পাললিক ভূমির উপর থেকে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদি জমি সম্প্রসারণ ও কৃষিসমাজ গঠনের যুগ।


মুসলমান পীররা (যাদের অনেকেই ধর্মীয় নেতা ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেছেন) এই সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় নের্তৃত্ব দিয়ে থাকলে তাদের অধীনে কারা মূল কাজ সম্পাদন করেছিল? সেই আম-জনতা যদি স্থানীয় হিন্দু হয়ে থাকে, তাহলে কেন তারা হিন্দু নের্তৃত্বকে পরিত্যাগ করে মুসলমানদেরকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল?


পতিত বনজঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদি জমি সম্প্রসারণ অনিবার্য ভাবেই সমাজের ভূমি বণ্টন ও উত্তরাধিকার সম্পর্কের সাথে জড়িত। সেটা কেমন ছিল? যেহেতু কৃষিজমি থেকে প্রাপ্ত কর এবং কৃষিপণ্যের ব্যবসা-বানিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয় রাজ্যের আয়ের মূল উৎস ছিল, অতএব পূর্ববাংলায় কৃষিজমি সম্প্রসারণে তৎকালীন রাজনৈতিক কাঠামোর (তথা, রাজা ও নানান স্তরের স্থানীয় শাসকশ্রেণীর) সম্পর্কই বা কিরূপ ছিল?


পূর্ববাংলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পল্লীসমাজের উদ্ভব নিয়ে অসীম রায়ের বর্ণনা উপরুল্লিখিত প্রশ্নমালার জন্মদেয়। তিনি এখানে সেখানে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেগুলো ঐতিহাসিক তথ্য এবং যুক্তির বিচারে অগ্রহণযোগ্য, যা’র কিছু কিছু আমি উপরে অসীম রায়ের বর্ণনার মধ্যে উল্লেখ করেছি। এসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও অসীম রায় বাংলার ইসলামাইজেশন নিয়ে গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নমালা উত্থাপন করেছেন এবং সেগুলোর উত্তর অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় সূত্র নির্দেশ করেছেন। এজন্য তাঁর The Islamic Syncretistic Tradition in Bengal (1983) বইটিকে বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাসে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য মনে করি।



























879 views0 comments

Recent Posts

See All

‘বাঙালি মুসলমানের মন’: গোঁজামিলের এক জ্ঞানবৃক্ষ

১ জাতীয় পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা আছে, আছে তার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ। মোটাদাগে, জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়...

Comments


bottom of page